প্রসঙ্গ আরাকানে গণহত্যা ও বাংলাদেশের অবস্থান
মোরা বীরের জাতি চলো এবার শাড়ি-চুড়ি পরি
খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
এমন ‘আকাইম্মা’ শিরোনাম দেখে এই আনাড়ি লেখকের আক্কেল-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে মর্মে ‘যৌক্তিক’ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য ইতোমধ্যেই অনেকে মন স্থির করে নিয়েছেন হয়তো। তবে কিছু পাঠকের ভাবনা ভিন্ন রকম হতেই পারে। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা স্বাধীনতা’ যারা ছিনিয়ে এনেছে সেই বীর বাঙ্গালিকে শাড়ি-চুড়ি পরার আহ্বান জানানো রাষ্ট্রদ্রোহ না হোক—জাতিদ্রোহের মতো বড় অপরাধ তাতে কি সন্দেহ আছে? কৈফিয়তে পরে আসছি। আজকের লেখার গোড়াতেই এ নিবন্ধকার কয়েকটি কথা দাবি করেই বলতে চাই:
এক. পৃথিবীর জন্মকাল থেকে তো বটেই ১৯৭১ সালেও গোটা পৃথিবী ‘অসভ্য’ ছিলো। সেই অসভ্য দেশগুলোর শীর্ষ কাতারে ভারত ছিলো অন্যতম। কেন? বলছি। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, কূটনীতি-পররাষ্ট্রনীতি সবরকমের হিসেব-নিকেশের নিকুচি করে ওরা স্বাধীন-সার্বভৌম প্রতিবেশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশি লাখ লাখ যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চিন্তা করুন! এটা কতবড় অপরাধ এবং ঘোরতর অন্যায় ছিলো। কয়েক লাখ বাংলাদেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। মানবিক বিবেচনায় প্রতিবেশি রাষ্ট্রের অসহায় শরণার্থীদের বড়জোর আশ্রয় দাও তাই বলে একেবারে যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া। সেই সময়কার ‘অসভ্য’ ভারত কিন্তু এতটুকুতেই থেমে যায় নি (উদ্দেশ্য আর অন্তরালের মতবলবই যাই হোক); মিত্রবাহিনী গঠন করে পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বা পৃথক হবার লড়াইয়ে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে রীতিমতো জঙ্গি তৎপরতায় সশস্ত্র মদদ দিয়েছে। এটা সভ্য পৃথিবীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো বৈ কি?
প্রিয় পাঠক, তামাশা তো আমি একদমই করছি না। আপনাদের ধৈর্যকে কষ্টেসৃষ্টে আর খানিকটা বাঁচিয়ে রাখুন! আন্তর্জাতিক অসভ্যতার আর কয়েকটি উদাহরণ দিয়েই আমি সংযতভাবে অগ্রসর হবো।
১৯৯০ সালে যে কারও অঙুলি হেলনে বা অন্য কোনো কারণে ইরাকের ‘স্বৈরশাসক’ সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত দখল করলো তখন কুয়েতের নিরুপায় ও বিপন্ন জনগণকে সামরিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা আর দখলকৃত দেশটির ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেবার জন্য পরিচালিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর প্রথম ইরাক আক্রমণও মোটা দাগে এক অসভ্যতাই তো ছিলো। ছিলো না?
এই লেখক না হয় অবাস্তব, অবান্তর ও ছেলেমানুষী মার্কা উদ্ভটসব আবেগী কথা লিখে কাগজ ভর্তি করছে। কিন্তু বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)-এর সাবেক মহাপরিচালক কী বলছেন একটু শোনা যাক!
মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের প্রস্তাব
নিউজ অর্গান টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সৌজন্যে জানা গেছে, জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় চ্যানেল আই তৃতীয় মাত্রায় অংশগ্রহণ করে গত রাতে সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সর্বশেষ সমাধান হল দুই লক্ষ রোহিঙ্গা ফোর্স তৈরি করে ব্যাক বাই আর্মি মিয়ানমারে পাঠিয়ে রাখাইন স্বাধীন করে দেয়া।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডিপ্লোমেটিক লাইনটা হওয়া উচিৎ যাতে ইউএন থেকে ফোর্স পাঠানো হয় রাখাইনে। এতে একটা লাইন ড্র হবে যাতে মিয়ানমার আলাদা হয়ে যাবে আর বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যাবে। বাংলাদেশে যে সকল রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি মনে করি অতিদ্রুত বাংলাদেশের উচিৎ ইউএন মিশন করা, যাতে শান্তি মিশন ইনভলভ হয়।
জেনারেল ফজলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে না পারে সেদিকে কঠোর নজর রাখা উচিত। বিশেষ করে তারা যেন ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারে। রোহিঙ্গারা এধরনের সম্পর্ক গড়ে তুললে বাংলাদেশকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে। একই সঙ্গে কক্সবাজারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশন ফুল ইকুইভমেন্ট অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহ ইমিডিয়েটলি সেখানে মুভ করা উচিৎ। এধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার আমাদের প্রস্তুতির জন্যে। এছাড়া বিজিবির চারটি ব্যাটিলিয়ন সেখানে রাখা উচিৎ, জরুরি প্রস্তুতির জন্যে।
জেনারেল ফজলুর রহমান আরও বলেন, এই দুঃখ-দুর্দশা ১৯৭৮ থেকে দেখে আসছি এটা আর কত দিন চলবে? মিয়ানমার এমন ফাজলামি করবে আর আমরা এটা মেনে নেব তা হতে পারে না। যদি মিয়ানমার সংযত না হয় তাহলে আমরা কি করবো? …আমি মনে করি এদেরকে এক জায়গায় রেখে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র দিয়ে অন্তত ২ লাখ ফোর্স তৈরি করে ব্যাক বাই আর্মি মিয়ানমারে পাঠিয়ে রাখাইন প্রদেশটাকে বাংলাদেশের অংশ করে নিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে যখন রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়া হচ্ছিল তখন সীমান্তে একটা ডিভিশন মুভ করা উচিৎ ছিল। যেমন যথেষ্ট হেলিকপ্টার, ফাইটার এয়ার কক্সবাজারে প্লেস করা হত। যুদ্ধের জন্য নয়। ঠিক একটা তাৎক্ষণিক তৎপরতা আমাদের সীমান্তের মধ্যে নেয়া। তাহলে মিয়ানমার একটা ম্যাসেজ পেতো। বাংলাদেশ সহজে ছেড়ে দেবে না।
সাংবাদিক রায়হান আজাদ তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েং সেদেশের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সরকার অনুমোদিত সামরিক অভিযান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়কালের ‘অসমাপ্ত কাজ’। এ কথার দ্বারা তিনি কি বুঝিয়েছেন জানেন কি? তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ১৯৪২ সালে তারা দু’লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং আরো প্রায় চার লক্ষ রোহিঙ্গাকে নির্বাসিত করেছে। অবশেষে ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর নব্বইয়ের দশকে, ২০০০ এবং ২০১২ ও ২০১৬ সালে ব্যাপক গণহত্যা চালায় বার্মিজ বাহিনী। তখন যাদেরকে হত্যা বা দেশান্তরীণ করতে পারেনি তাদেরকে এ যাত্রায় হত্যা ও বিতাড়িত করার মিশন নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে। পিশাচকন্যা সুচি যত কথাই বলুক না কেন তার সেনা প্রধানের ভাষ্যে আসল মতলব উঠে এসেছে। তাই এ পর্যায়ে মিয়ানমারকে জাতিগত নিধনের অপরাধে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। প্রয়োজনে মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। সুতরাং শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, ঘেরাও- বর্জন অব্যাহত রাখুন। সবচেয়ে কাজের কাজ হবে সাইবার হামলা জোরদার করে এ বর্বর রাষ্ট্রকে কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দিন।
উদ্ধৃতি দুটি দীর্ঘ হলেও এর গুরুত্ব বিবেচনায় আশা করছি পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করে নি। এবার তো লেখকের প্রতি সদয় হোন! চার লক্ষাধিক শরণার্থীকে জায়গা দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে দেশ-বিদেশের সকলেই তার প্রশংসা করছে, আমরাও সরকারকে অভিনন্দন জানাই। তবে যোগাযোগমন্ত্রীসহ সরকারের কেউ কেউ যখন মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে আরাকানে যৌথ অভিযানের খায়েশ এবং ‘সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বার্মার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না’ কিসিমের আগ বাড়িয়ে বাড়তি কথা বলেন, তখন জনগণ ক্ষুব্ধ-হতাশ ও বিরক্ত হতেই পারে। আমাদের কথা হলো, সীমান্ত বর্ষণ না করো গর্জন তো করতে পারো! যাতে কাপুরুষ ও এই হিংস্র শেয়ালগুলো বাঘের মতো বাহাদুরী না দেখাতে পারে এবং গোটা দুনিয়াটাকে মগের মুল্লুক না ভাবতে থাকে।