হে আল্লাহ, বাংলাদেশের মানচিত্র রক্ষা করো
একজন মুন্সী মেহেরুল্লাহর প্রয়োজন
মুহাম্মাদ নূরুল্লাহ
ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী আবারও বাংলাদেশকে নিশানা বানিয়েছে। বাংলাদেশ দখলের মাধ্যমে আবারও ভারতবর্ষ পদানত করার স্বপ্ন তাদের। এবার তাদের বাংলাদেশ আগমন হয়েছে ধর্মের বাতাবরণে। সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশল এই খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নামে দেশে দেশে তাদের লক্ষ বাস্তবায়নে সূচনা হয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর হতে। আজ বাংলাদেশের কতভাগ জমির মালিক হয়েছে সাতসাগর তের নদী পেরিয়ে আসা ফাদাররা, দেশের মোট পুঁজির কতভাগ তাদের দখলে সেখবর আমরা জানি না। খ্রিস্টান মিশনানুকূল ধর্ম প্রচারের নামে এ দেশটাকে আবারও কেড়ে নিতে কত রকম কৌশল গ্রহণ করেছে, এর মধ্যে আমাদের দেশের কত গুরুত্বপূর্ণ পদবীধারীকে কেনা হয়েছে সে সংবাদ অজানা। আমাদের মনে রাখতে হবে, পলাশীর যুদ্ধের আগে এ দেশের একজন দুশ্চরিত্র সেনাপ্রধানকে কিনে নিয়ে বিনাযুদ্ধে তারা বাংলাদেশ দখল করেছিল। তারপর এদেশের মানুষকে সর্বদিক থেকে নিঃস্ব করে তাদের উন্নত শিক্ষা, আদর্শ, সংস্কৃতি, চরিত্র ও ঈমান বরবাদ করা হয়েছিল। সেই যে দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত আমরা তারপর আজও কোমর সোজা করে দাঁড়াতে সক্ষম হইনি। বাংলার সম্পদ লুট করে আধুনিক ইউরোপ, আমেরিকা শক্তিশালী হয়েছিল। আর এদেশের মানুষকে দুর্ভিক্ষ, মহামারির কবলে বারবার ছুঁড়ে দিয়ে কোটি কোটি হত্যা করে তাদের পাশবিকতা চরিতার্থ করেছিল। আমরা হয়তো ভুলে গিয়েছি সেই সব খুনের ইতিহাস, বীভৎস কাহিনী, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হওয়ার বেদনার সাতকাহন। ওই আদা, মরিচ, তামাকের বিক্রেতারা পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী একটি দেশের মালিকানা পেয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। সেই পশুচরিত্র, লুটেরা সাদামুখো সাহেবরা এবার বাংলাদেশে এসেছেন ধর্মের আলখেল্লা পরে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতের বাদশার দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি গিয়েছিল একজন চিকিৎসকের বেশ ধরে। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, এরা ভারতবর্ষে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবসময় বাংলাকে বেছে নিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিও চেয়েছিল বাংলাকে আগে দখল করে গোটা ভারতবর্ষ পদানত করবে। এটা ইউরোপীয়দের কৌশল। আজ ধর্মপ্রচারক পাদরিরা যে কায়দায়, অর্থের প্রলোভন দিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে সাধারণ মানুষকে, কোমলপ্রাণ শিশুদেরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করছে। তারা যেসব পন্থা ও পরিকল্পনা এবং রূপরেখা প্রণয়ন করে পথ চলছে এখনি তাদের রাশ টেনে না ধরলে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে দুর্ভাবনা আছে। তাদের গতিরোধ করা জরুরি। তাদের ভেল্কিবাজি সম্পর্কে তাদের সাবধান করতে হবে, জনগণকেও জানাতে হবে। অনেকে ভয়ে তাদের কিছু বলতে চায় না আবার নানান জটিলতায় নিজেকে নিক্ষেপ করতে হয় কিনা। আবার ওরা প্রতিবাদকারীকে আল-কায়েদার সদস্য ঘোষণা করে ফেলে কিনা। এই ভয় আজ ভাঙতে হবে। নিরীহ বাঙালির কপালে না হয় আরও অনেক দুঃখের খবর আছে। পিছনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করা উচিত আমাদের।
আজ দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে এতবেশি রেষারেষি আর অবিশ্বাস যে জনগণ তাদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। এদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাড়ির বন্ধন নেই। জনগণের বিশ্বাস ও চেতনার সঙ্গে তাদের মিল নেই। এরা দুনিয়াদারির চরম কদর্যরূপ, স্বার্থের প্রশ্নে এতটা নীচে নেমে গেছে যে, আপাদমস্তক মুসলমান নেতৃত্বের কোনো বৈশিষ্ট্য ওদের বাকি নেই, দেশের ক্ষেত্রেও তাদের কোনো প্রতিশ্রতি নেই। এদের অধিকাংশই পরিবার-আত্মীয়-স্বজন আগেভাগে পাঠিয়ে দিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার শহরগুলোতে। দেশের অস্তিত্বের তরে তাদের জীবন দান করা সম্ভব নয়। দেশ বিক্রি করে দিয়ে তারা পালিয়ে যেতে পারে যেকোনো সময় অনেকেই সেটা ভেবে থাকেন। অনেক রাজনীতিকের ক্ষেত্রে যেমন, অধিকাংশ শিল্পী, কবি, আমলা, পেশাজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, তথাকথিত সমাজকর্মী, অধিকারকর্মীর ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। এদের কাছে আমরা সত্যিকার দেশপ্রেমের লক্ষণ দেখতে পাই না। এরা দেশপ্রেমিক হলে দুর্নীতিতে অংশ নেয় কীভাবে? রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের চেয়ারে বসে ঘুষ ও উপঢৌকন গ্রহণ করে কেনো? আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের যেকোনও দুর্যোগে উল্লিখিত শ্রেণিগুলো চলে যাবে প্রভুদের আশ্রয়ে। এ দেশটায় পড়ে রইবে দুর্ভাগা গরীব জনগণ এবং আলেমসমাজ। শোষকের শোষণ ও নির্যাতন তাদেরই ভুগতে হবে। এজন্য দেশের প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে সর্বোচ্চ সচেতনতার পরিচয় তাদেরকে দিতে হবে, আমরা যারা এদেশে বাস করবো। একারণেই খ্রিস্টান মিশনারি সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত (কাদিয়ানি চক্র) এর সমস্ত কুকর্ম রুখে দিতে এখনি সোচ্চার হতে হবে। এই সরকার জনবান্ধব অনেক কাজের প্রুতিশ্রুতি দিয়েছে। আমাদের এই দাবি তাদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ শাসনের উত্তুঙ্গ সময়টিতে যখন রাজ প্রশ্রয়ে উচ্ছৃঙ্খল উগ্র বদমাশ পাদরিদের উপদ্রব বাংলায় বেড়ে গিয়েছিল এবং এদের এমনই প্রভাব যে, এরা ঢুকে পড়তো যেকোনও ধর্মীয় সমাবেশে আর সমস্ত অশ্লীল বাক্যবাণ নিক্ষেপ করতো ইসলাম ধর্মের ওপর; ইসলামের সম্মানিত পয়গম্বর (সা.)ও আদর্শ ব্যক্তিদের তারা গালাগাল ও নাজেহাল করতো, তখন তাদের টিকিটি স্পর্শ করার সাধ্য কারও ছিল না। প্রতিবাদ মানেই নিশ্চিত গুম, আত্মহত্যাকে ডেকে আনা—এ ঝুঁকি কে নিতে পারতো। দেশের জনগণকে তখন মুখ বুঁজে সব সইতে হতো। এমনই এক কঠিন সময়ে দেশীয় কায়দায় উগ্র পাদরিদের মুকাবিলায় নামেন কম ইলমসম্পন্ন, যশোর জেলার এক দরিদ্র গ্রাম্য দর্জি মুন্সী মেহেরুল্লাহ (রহ.)।
তিনি এই উচ্চশিক্ষিত পাদরিদের প্রকাশ্য বাহাসের জন্য আহ্বান করলেন। তার সঙ্গে বাহাসে পরাজিত হয়ে পাদরিরা রাতের আঁধারে গা ঢাকা দেয়। নাম রটে যায় মুন্সী সাহেবের। আরও বড় কাণ্ড ঘটে পাদরি জন জমিরুদ্দিন নামের এক জাঁদরেল পাদরি খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ইসলাম গ্রহণ করে মুন্সী মেহেরুল্লাহর শিষ্যত্ব বরণ করেন। এরপর আল্লাহপাক মুন্সী মেহেরুল্লাহর দ্বারা বাংলার বিগড়ে যাওয়া মুসলমানদের ঈমানকে সুদৃঢ় করেন। তিনি সমস্ত বাংলাদেশ সফল করেন। আল্লাহ পাক তাঁর মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের ঈমানকে হেফাজত করেন। বাংলাদেশি জনগণ সংশয় ও ইরতিদাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পান। আজ খুবই পরিতাপের বিষয়, এমন একজন মুন্সীর বড় অভাব আমাদের। বাংলাদেশের সমস্ত সীমান্ত জনপদ আর বিশেষ শহরগুলোতে গোপনে ইরতিদাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তরুণরা যাতে সংশয়বাদে মজে যায় এজন্য সুপরিকল্পিত অনেক কাজই সম্পন্ন হয়েছে। সরকার এক্ষেত্রে নীরব, নির্বিকার। এটা দুঃখের বিষয়। একজন মুসলমানের জন্য এ অবস্থা মেনে নেওয়া খুবই বিপদজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। চাল পুড়ে যখন আগুন শরীরে এসে লাগবে তখন সচেতন হয়ে লাভ হবে না।
এসব ঘটনায় কতিপয় আলেম বিচলিত বোধ করছেন। তাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে সীমান্তের মানুষের কাছে গিয়েছেন। সেই সব অসহায় দরিদ্র মানুষ আলেমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে, দীনের কথা শুনে খুবই অবাক হয়েছেন। অনেকের ঈমানের নবায়ন হয়েছে। আমাদের ভাবতে হবে আমরা জাতীয় প্রশ্নে দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি। মসজিদ, মাদরাসার ধরাবাধা কাজের বাইরে আমরা এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ঈমান, আকিদা ও চরিত্র, ও নৈতিকতা নিয়ে কতটুকু চিন্তা করছি। আলেমদের মধ্যে যদি সচেতনতা সৃষ্টি হয়, বেদনাবোধের সাড়া পড়ে তাহলেই মুন্সী মেহেরুল্লাহর মতো জাতীয় পুরুষের আবির্ভাব সময়ের ব্যাপার। যিনি অকুল প্রেমের বাণ ঢেকে বাংলাদেশ ভাসাবেন।
আমার ভাবতে দুঃখ লাগে, ইংলো-বর্ণহিন্দু শোষণের যুগে আমাদের ভিত যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন যে সচেতনতার পরিচয় আমরা দিয়েছি আজ স্বাধীনতার শতাব্দীকাল প্রায় অতিক্রান্ত হলেও জাতিনির্মাণ ও আত্মগঠনে সেই সজ্ঞা ও চেতনার পরিচয় আমরা দিচ্ছি না। সার্বিক অবস্থা বিচার করলে হতাশার অন্ধকার দেখি। আবার এর মধ্যে আশার আলোও দেখতে পাই। আল্লাহ জানেন আমাদের ভাগ্যে কী আছে। কী আছে বাঙালি উম্মাহর কপালে।
হে আল্লাহ, তুমি বাংলাদেশের মানচিত্র রক্ষা করো। এখানের বাঙালি মুসলমানের ঈমান, জীবন ও সম্পদকে তুমি রক্ষা করো।