মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.) জ্ঞানী ও ধ্যানী
মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন
সবাই কামেল লোক হিসেবে, তাঁর কারামতি সম্পর্কে যতটুকু জানে, তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও বিশালতা এবং কাব্যিক প্রতিভা সম্পর্কে কমই জানে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম। সেটা হয়তো তাঁর আত্মপ্রচারে অনীহা কিংবা আধ্যাত্মিক আকুলতায় অধিক আবিষ্ট হওয়ার কারণেও হতে পারে। তাছাড়া পরিবার বা প্রিয়জনদের পক্ষ থেকেও এমন কোনো প্রচার বা প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যাতে তাঁর কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে, বুঝতে পারে। তবে নিজ সমকালে প্রজ্ঞাবান পুরুষ হিসেবে, কবি হিসেবে, তিনি সুপরিচিত ও সুখ্যাত ছিলেন। তিনি আর কেউ নন—মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.)। তাঁর কাব্য-প্রতিভা সম্পর্কে কিছু পেশের পূর্বে তাঁর পূর্ব-পুরুষের পরিচয়, পারিবারিক জীবন, পাঠ্য জীবন, পাঠদান পর্ব, সামাজিক জীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কেও আলোকপাত করা আবশ্যক। কেননা তাঁর জীবনের এই বিভিন্ন পর্ব বা অধ্যায় বুঝলে পরে, তাঁকে যেমন তেমনি তাঁর কবিতাকেও বোঝা সহজ হবে। তাছাড়া কবিতা তাঁর কাছে জীবন-বিচ্ছিন্ন তথা করোটির কালাম ছিলোনা, ছিলো কলবের কালাম। শিল্পের জন্য শিল্প বলে যে একটি শয়তানি স্লোগান একসময় শোনা যেতো, তেমনটা নয় তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা করোটির কালামও নয়, কলবের কালাম।
মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.) আনুমানিক ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলাস্থ ৯ নং মিরসরাই ইউনিয়নের মান্দারবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজি কুনা মিয়া এবং মাতার নাম সফর বিবি। তাঁর আদি পুরুষরা ছিলেন আরবের অধিবাসী। উত্তরকালে তাঁদেরই কেউ কেউ চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাণিজ্য সুবিধা তথা বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম ছিলো প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোকেরা চট্টগ্রামে আসতো— কেউ বাণিজ্য করতে, কেউ বাণিজ্যের সাথে সাথে ধর্মও প্রচার করতে। বিশেষ করে আরবের অধিবাসীরা আসতো বাণিজ্যের পাশাপাশি ধর্ম প্রচার করতে। মওলানার আদি পুরুষরাও যে সে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে তাঁর যে পূর্ব পুরুষরা বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের বংশধরদের মধ্যে কেউ কেউ বসতি গড়ে তুলেছিলেন বাঁশখালীতে, কেউ কেউ মিরসরাইয়ের মান্দারবাড়িয়ায়। মান্দারবাড়িয়ায় বসতি স্থাপনকারী যে একজন পূর্বপুরুষের নাম পাওয়া যায়, তাঁর নাম শেখ জিন্নত আলী মিঞাজি। তাঁর ছিলো দুই ছেলে—যাদের একজনের নাম আরব আলী, অপরজনের নাম জাফর আলী। ১৯০৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরসরাই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত দু-ভাইয়ের মধ্যে সম্পাদিত একটি বণ্টকনামা দলিলে (দলিল নং ৪৭১) দেখা যায়, তাঁদের জাতি পরিচিতিতে ‘শেখ’ এবং ব্যবসা হিসেবে ‘জমিদারি’ শব্দটি লেখা আছে। আরব আলীর ছিলো দুই ছেলে। একজনের নাম (হাজি) কুনা মিয়া, অপরজনের নাম (মুন্সী) সোনা মিয়া। সেই কুনা মিয়া ও সফর বিবির প্রথম সন্তান হলেন মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.)। মওলানার পিতা-মাতা উভয়েই পরহেজগার ও ধর্মনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কয়েকজন বুজুর্গানে দীন ছিলেন বলেও জানা যায়।
মওলানার পড়ালেখার প্রারম্ভ প্রথমে পিতা-মাতার কাছে, পরে স্থানীয় মক্তবে। এরপর তাঁকে ভর্তি করানো হয় মিঠাছরা মাদরাসায়। নিযামপুর পরগণায় যে দুটি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে পরিচিত তার একটি মিঠাছরা মাদরাসা, অপরটি আবুরহাঁট মাদরাসা। ১৮৮১ সালে বিশিষ্ট আলিম ও অলিয়ে কামিল মওলানা সাজেদুল্লাহ (রহ.) (১৮৬০/১৯৩৬ খ্রি.) মিঠাছরা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদরাসা পড়ালেখা ও তাকওয়ার তালিমের ক্ষেত্রে এতটাই সুনাম অর্জন করেছিলো যে, দূর-দূরান্তের, বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড থেকেও ছেলেরা এসে এই মাদরাসায় ভর্তি হতো। মওলানা সাজেদ উল্লাহ (রহ.) ছিলেন মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.)-এর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুরু এবং আধ্যাত্বিক গুরু। গুরুর গুরুত্ব যে কত বেশি তা বলতে গিয়ে মওলানা তাঁর ফাযায়েলে এলেম তথা জ্ঞানের গুণ শীর্ষক কবিতার একস্থানে লিখেছেন,
উঁচুমানের মণিমুক্তা যেন উস্তাদগণ,
মা-বাবা থেকেও হক বেশি তাদের, কর শ্রবণ।
হয় শরীর আবাদ মা-বাবার লালন-পালনে,
অন্তর সজীব হয় শিক্ষাগুরুর শিক্ষার কল্যাণে। (কাব্যিক রূপান্তর: মাশুক মাশরেকী)
মওলানা সাজেদুল্লাহ, যিনি ছিলেন মওলানার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুরু, তাঁর শানে রচিত এক আরবি কসীদায় মওলানা লিখেছেন,
হে আল্লার জন্য সিজদাবিনত সাজেদুল্লাহ,
ওলীকে ভুলো না;
আমার জন্য দোয়া করে যেও—যতক্ষণ বেঁচে আছো।
হে আল্লার জন্য সিজদানত সাজেদুল্লাহ,
তুমি সৃষ্টি-প্রজাতির শিক্ষক,
তোমার কুলপ্লাবী কল্যাণ
পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে।
হে আল্লার জন্য সিজদানত,
তুমি জ্ঞান-বিজ্ঞানের দাতা:
পৃথিবীর বোদ্ধা আর সমঝদারদের কাতারে
তোমার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
(কাসায়িদ কাব্যগ্রন্থ থেকে, অনুবাদ: সালাহউদ্দীন আইয়ুব)
মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী মিঠাছরা মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। আলিম পাশ করার পর তিনি কি হাটহাজারী মাদরাসায় পড়েছিলেন? সম্প্রতি প্রাপ্ত এক তথ্য কিন্তু সেই সত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। মওলানা আহমদ হাসান (রহ.) প্রণীত মশায়েখে চাটগাম (প্রকাশ: মার্চ ১৯৮৮, জিরি মাদরাসা, চট্টগ্রাম, পৃ. ৯৭-৯৮) পুস্তক পাঠ করে জানা যায়, উক্ত মাদরাসার উস্তাদ মওলানা আবুল হাসান (রহ.)-এর ছাত্র ছিলেন মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.)। ফয়েয আহমদ ইসলামাবাদীর তাযকিরায়ে যমীর গ্রন্থে (প্রথম সংস্করণ ১৯৫৯, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) হাটহাজারী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা শাহ যমীরুদ্দীন (রহ.) (১২৯৬-১৩৫৯ হি.)-এর শানে মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরীর যে একটি কবিতা আছে, সেখানেও মওলানার সেই পাঠশালায় পড়ার ইঙ্গিত মেলে। উক্ত কবিতায় তিনি মওলানা যমীরুদ্দীনকে ‘হে আমাদের শায়খ যমীরুদ্দীন’ বলে উল্লেখ করেছেন। কবিতার এক জায়গায় শায়খ যমীরুদ্দীন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
জ্ঞানের জগতে দেখেছি তাঁকে
নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে।
এ পথের অভিযাত্রীরাও তাঁকে পেয়েছে
উত্তম এক ইমাম হিসেবে।
(আরবি থেকে অনুবাদ: ড. আবু বকর রফিক)
অতঃপর উচ্চশিক্ষার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মওলানা পাড়ি দেন ভারতে। ভর্তি হন ভারতের সাহারানপুর মাযাহিরে উলুম মাদরাসায়, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে কিছুকাল অধ্যয়ন শেষে তিনি ভর্তি হন দুনিয়াখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ (বিশ্ববিদ্যালয়)-এ। দেওবন্দ সম্পর্কে দুচার কথা বলতে গেলে চলে আসে দরসে নিযামিয়ার কথা। হযরত মোল্লা ফিরিঙ্গি মহল্লী (রহ.) (জন্ম ১০৯০ হি.) যে দরসে নিযামীয়ার প্রবর্তন করেছিলেন, দেওবন্দের পাঠ্যক্রম সেই প্রজ্ঞাধারারই পবিত্র প্রস্রবণ। এর সাথে যোগ হয়েছিলো হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.)-এর চিন্তাধারা। তরিকার দিক থেকে দেওবন্দীরা চিশতিয়া তরিকার অনুসারী এবং সব তরিকার সুসমন্বয়কারী। কি তত্ত্বগত তালিম, কি তাসাউফের তালিম, তখন সব দিক থেকে দেওবন্দ ছিলো দুনিয়ার সেরা পাঠকেন্দ্র। সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা পড়তে যেতো সেখানে। দেওবন্দের গুণগত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.) বলেছেন, ‘তখন দারুল উলুমকে দিনের বেলা দেখা যেত একটি মাদরাসা যেখানে হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, উসুল ও আকায়িদ বিষয়ক ইলমে যাহিরীর শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আর রাতের বেলা মনে হতো একটি ‘খানকা’ যেখানে যিকর-আযকার, রিয়াযত ও মুজাহাদার মাধ্যমে তাযাকিয়ায়ে নাফস ও ইলমে বাতিনের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষতম ব্যক্তিত্ব থেকে নিম্নতম পাহারাদার পর্যন্ত সকলেই ছিলো অন্যতম অন্তরালোক সম্পন্ন বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। (উদ্ধৃতি ড. মুশতাক আহমদ প্রণীত শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী, প্রকাশ: মে ২০০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ. ৯০-৯১)
হাকিমুল ইসলাম হযরত মওলানা কারী মুহাম্মদ তাইয়েব বলেছেন, ‘পূর্বে দারুল উলুমে তাসাউফের পূর্ণতা অর্জন ব্যতিরেকে কাউকে সার্টিফিকেট পর্যন্ত দেওয়া হতো না (পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৪)।’ ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিং তাঁর বহুল আলোচিত বই JINNAH India—Partition Independence (৬ষ্ঠ সংস্করণ ২০০৯)-এর প্রথমদিকের এক পৃষ্ঠায় প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন, Deoband, this great Islamic seminary, some distance out of Delhi, and now renowned internationally as one of the great Centres of Islamic learning… (P. 34). মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী’র আরবিতে লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা আছে দুনিয়াখ্যাত দেওবন্দকে নিয়ে। কবিতাটির প্রারম্ভিক কিছু পঙক্তি (আরবি থেকে ভাবানুবাদ) নিম্নে পেশ করা হলো:
আমি গিয়েছিলাম দেওবন্দে জ্ঞান
আহরণ করতে,
সেখানকার শায়েখদের কাছ হতে।
যখন গিয়ে সেথায় পৌঁছলাম,
দৃশ্য তার দেখে অবাক হলাম!
এটা কি স্বর্গ নয় দুনিয়ার?
প্রত্যাশার ফলগুলো যার,
শোভা পাচ্ছিলো প্রশাখায় তার।
সম্মানিত ও দয়ালু ছিলেন
সেখানকার শায়েখগণ;
সকলকেই তাঁদের, হচ্ছিলো মনে
নির্ভীক সব পাখির মতোন।
যখন তাঁরা কথা বলেন;
তাঁদের সেই কথা থেকে,
যেন মুক্তো ঝরে পড়ে একে একে।
(ভাবানুবাদ: মাশুক মাশরেকী)
কবিতাটি সম্পর্কে কমেন্ট করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব তাঁর আলোকতীর্থ দেওবন্দ ও মওলানার একটি শিরোনামহীন কবিতা শীর্ষক রচনার এক জায়গায় লিখেছেন, ‘দেওবন্দ কি শুধুমাত্র একটা ভবন? একটা স্থাপত্য? এ কি পৃথিবীর মধ্যেই জান্নাত রচনা করেনি—এ কি সেই প্রতিশ্রুত, পবিত্র উদ্যান আর বাগান নয়, পুষ্পিত বৃক্ষের সারি যার আবেষ্টনী; যার শস্যভারানত ডালে ডালে বসে আছে বিভিন্ন পাখি, যাদের কলরবে মুখরিত এর আঙিনা? কারা ওই পাখি, কী গুঞ্জন তুলেছে ওরা ওই মনোরম উদ্যানে, কী-ই বা অমন সৌরভ যাতে সচকিত না হয়ে উপায় নেই? কী সেই ব্যাপার যাতে বস্তু হয়ে ওঠে বৃক্ষ, বৃক্ষে জাগে প্রাণ, প্রাণ থেকে জন্ম নেয় এক আদিগন্ত প্রকৃতির আবহ: ঠিক এইরকম একটা ধারাবাহিকতায় মওলানা তাঁর অভিজ্ঞতা ও অভিভূত অবলোকনের বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। মওলানা মীমাংসিত যে, ‘বস্তু’ তার নিজের গুণে নয়, বরং ইতিহাসের সজীব কুশীলবদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে হয়ে ওঠে মূল্যবান। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন বলে নয়, সমকালের সেরা বিদ্বান ও বুজুর্গদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির মধ্যে দিয়েই এর কীর্তির পরিমাপ ও ঐতিহাসিকতার অনুধাবন সম্ভবপর।’ (মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী স্মারকসংকলন, প্রকাশকাল: ১৮ জুলাই ২০০৩, চট্টগ্রাম; সম্পাদক: মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, পৃ. ১২১)
মওলানার কবিতাটি সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে ড. এম এ গফুর তাঁর মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী ও তাঁর সমকাল শীর্ষক লেখার একস্থানে লিখেছেন, ‘দেওবন্দের আকাশচুম্বী মনোরম অট্টালিকা, বিশ্ববরেণ্য শিক্ষকমণ্ডলী এবং অসংখ্য গ্রন্থাবলীর সমাবেশ দেখে শিক্ষার্থী ওলী আহমদ স্বতস্ফূর্তভাবে আরবি ছন্দোবদ্ধ ভাষায় দেওবন্দের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যেকোনো আরবি কাব্য রসিককে আনন্দ না দিয়ে পারে না। এ কবিতার ভাষা সরল, সহজ ও স্বচ্ছ এবং নিখুঁত। কবিতার প্রতিটি ছত্র গতিময় ও বাঙময় হয়ে উঠেছে। দেওবন্দের সাক্ষাৎ পরিচয় এবং এর আনন্দঘন পরিবেশ শিক্ষার্থী ওলী আহমদের মনেপ্রাণে নতুন জগতের যে শিহরণ জাগিয়েছে তারই প্রতিচ্ছবি তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৬)
ভারতে অধ্যয়নকালে ভূবনখ্যাত যেসব বিদ্বান ও বুজুর্গানে দীনকে মওলানা উস্তাদ হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.), শায়খুল হাদীস মওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.), সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.), হাকিমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.), মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহ.) প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। বিশ্বখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরাতে মাআরিফুল কুরআন-এর লেখক মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) ছিলেন দেওবন্দ অধ্যয়নকালে মওলানার সুহৃদ ও সহপাঠী। উল্লেখ্য একবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সফরে এলে মওলানাকে দেখতে মিরসরাইয়ের মান্দারবাড়িয়ায় এসেছিলেন মুফতি শফী (রহ.)। সেটা পঞ্চাশ দশকের পরে।
মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.)-এর রুহানি রাহবার তথা আধ্যাত্বিক আলোকদিশারী ছিলেন শায়খুল হিন্দ মওলানা মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.)। সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ তাঁর আত্মজীবনীতে মওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.)-কে ‘ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম’ বলে অভিহিত করেছেন। (দ্র. ইবরাহীম খাঁ রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৪, পৃ. ২২৯)
মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাঁকে ‘এছলাম জগতের সর্ব্বপ্রধান আলেম এবং সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। (দ্র. মৌলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৩; পৃ. ২৯৩)
‘সীমান্ত গান্ধী’ খ্যাত খান আবদুল গাফ্ফার খান তাঁর আত্মজীবনীর একস্থানে লিখেছেন, ‘দেওবন্দ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ-উল-হাসান সাহেব পন্ডিত লোক ছিলেন।; (দ্র. গাফ্ফার খানের আত্মজীবনী, মুক্তধারা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, পৃ. ৩১)
স্বীয় রুহানি রাহবার মওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মওলানা কাসেম নানুতুভী (রহ.)-এর শানে লেখা এক কবিতার একস্থানে মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (রহ.) লিখেছেন,
আমার সুযোগ্য পীর রাহাগির মাওলানা মাহমুদ হাসান,
কি উচ্চ এলম তাঁর খ্যাতি রয় চতুর্দিকে-সুমহান শান।
ফয়েজ তাঁর আজ বেহেশতের তাসনীমের হুর অনুরূপ,
পবিত্র বরকতে হয় লাজ নম্র হুর অপরূপ।
কিয়ামত তক যেন জারী থাকে তাঁর ফয়ুজাত,
এলমের সাগর সেঁচে পাই যেন হাসীন প্রভাত।
……
তাঁহার নৈকট্য লাভে ধন্য যেন হতে পারি প্রভু,
বেহেশতী আলোর বাগ—যেন না হারাই কভু। (ভাষান্তর: জহুর-উশ-শহীদ)
দেওবন্দে সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অধ্যয়ন করেন তিনি। মওলানা গোলাম রহমান (রহ.) তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেন, ‘দেওবন্দ দারুল উলুমে কাফিয়া এবং শরহে জামী থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত উচ্চতর বিষয়সমূহ (তিনি) অধ্যয়ন করেন।’ (দ্র. মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী স্মারক সংকলন, পৃ. ১৫০)
মুফতি মুহাম্মদ আলী আযম (রহ.) তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেন, ‘সে সময় শিক্ষকগণের কাছ থেকে তিনি সব ধরনের জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞান অর্জন করেন। বাঙালি হওয়ার পরও দেওবন্দ মাদরাসায় তিনি সকল ছাত্রের ওপর প্রথম স্থান অধিকার করতেন। তাঁর কারণেই প্রত্যেক বাঙালির সম্মানজনক স্থান ছিল সেখানে।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৯)
অবশেষে সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দেওবন্দী সনদ লাভ করেন। পাশ করার পর সেখানকার সম্মানিত উস্তাদগণ মওলানাকে দেওবন্দে অধ্যাপনা করার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু নিজ দেশের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করার আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করে তিনি সেই প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন, ফিরে আসেন আপন জন্মভূমিতে। এসে কিছুদিন তিনি মাতা-পিতার স্নেহ সান্নিধ্যে কাটান। অতঃপর যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। প্রথমে যোগ দেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদরাসায় (প্রতিষ্ঠা-১৯০১)। সেখানে তিনি উচ্চ আরবির শিক্ষক ও মুহাদ্দিস হিসেবে স্বীয় দীনি খেদমত আনজাম দেন। সেখানে দুই বছর পর্যন্ত পড়িয়ে তিনি যোগ দেন ফতেহপুর নাছেরুল ইসলাম মাদরাসায় (প্রতিষ্ঠা: ১৯১৭), যা বর্তমানে জামেয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম নামে পরিচিত। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী লিখেন, ‘উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, বুযুর্গ ও কবি মাওলানা ওলী আহমদ নিজামপুরী (রহ.) ফতেহপুর মাদরাসার সাবেক উস্তাদ। মাওলানা আবদুল হামিদ (রহ.)-এর আকর্ষণে তিনি ফতেহপুর মাদরাসার শিক্ষকতার পদ গ্রহণ করেছিলেন।’ (আন-নাছের, জামেয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম ফতেহপুর-এর শতবর্ষ স্মারক ১৯১৭/২০১৬, পৃ. ১৯৬)
সেখানে প্রধান শিক্ষক (মুহতামিম) হিসেবে পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত থেকে বিদ্যা বিতরণের সুমহান সেবায় সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহু আলেম-ফাজেল তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে দীনের দর্পনে নিজেদেরকে গড়ে তোলার সৌভাগ্য লাভ করেন এবং সেই সাথে সম্মান ও সফলতারও অধিকারী হন।
অতঃপর আরম্ভ হয় তাঁর অন্যজীবন—আধ্যাত্মিক জীবন। সেটা কি? উৎসের দিকে ফেরার পিপাসা বা আকুলতা। সেই ফেরা আর কিছু নয়, পরম প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন। মওলানা রুমী তাঁর বিশ্বখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মসনবীর যে মুখ রচনা করেছেন, সেখানেও বাঁশির বিলাপের মধ্য দিয়ে সেই করুণ সুর ধ্বনিত। কবি ইকবাল তাঁর কাব্য অনুপ্রেরণা লাভ করেন রুমি থেকে এবং তার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর বিশ্বখ্যাত কাব্যগ্রন্থ আসরারে খুদী-তে। এর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
জীবন যখন শক্তি সঞ্চয় করে আত্মা থেকে,
জীবন তটিনী বিস্তার লাভ করে
সমুদ্রের মহত্বে।
জন্মগতভাবেই মওলানা ছিলেন আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। শিক্ষকতা জীবন শেষ করে পুরোপুরিভাবে তিনি আধ্যাত্মিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আবদুর রহমান (হার্ভার্ড স্কলার, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও স্বাধীনতা উত্তর প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ড. নুরুল ইসলামের পিতা) ছিলেন মওলানার একজন ভক্ত। নিজের আত্মজীবনীতে মওলানা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেন, ‘সংসারের সুখ-দুঃখের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, এই মাওলানা ছিলেন চিরকুমার। হাটহাজারী থেকে অধ্যাপনা ত্যাগ করে আপন বাড়িতে অধ্যয়ন ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকেন। আচারে ব্যবহারে ও কথাবার্তায় নম্র বিনয় এবং পোশাক-আশাক ও বিষয়-আশয়ে ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। …তাঁর সঙ্গে এই আমার প্রথম দেখা। মনে হল একটি সংসার-বিরাগী লোক জ্ঞান চর্চায়, নিভৃত তপস্যায়, গরিব দুঃখীদের সেবায় ও সৎপথে চালিত করার চেষ্টায় লোকারণ্যের মায়া কাটিয়ে শহর থেকে দূরে গণ্ডগ্রামের এক ভগ্ন কুটিরে মনের সুখে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। কোনো ফকিরী বুজুরগি নেই। দরবেশি দম দেওয়াও নেই। মনে হল যেন পুরাকালের অতি সরল নিরহঙ্কার এক জ্ঞানী ও ধ্যানী মধ্য এশিয়ার পর্বত গুহা ছেড়ে বর্তমানের সাংসারিক ঘুর্ণিবাত্যায় এই গণ্ডগ্রামের ভগ্ন কুটিরে আশ্রয় নিয়েছেন।’ (যতটুকু মনে পড়ে, [৬০০ পৃষ্ঠার সমৃদ্ধ আত্মজীবনী]—আবদুর রহমান, নভেম্বর ১৯৭২, রহমান সন্স পাব্লিকেশান্স, ক্রিসেন্ট প্রেস, ৪৬ কোর্ট রোড, চট্টগ্রাম)
অতঃপর তিনি লিখেন, ‘এর কিছু দিন পরে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে কলেজিয়েট স্কুলের হোস্টেলের একটি খালি রুমে আস্তানা গাড়েন। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।’ (পূর্বোক্ত)
কেবল কলেজিয়েট স্কুলের হোস্টেলেই নয়, মাদারবাড়ি পোড়া মসজিদের পাশে, বাদশা মিয়া সওদাগরের দোতলায় এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় থেকেছেন তিনি। তখন তিনি এত মশহুর যে, শহর কুতুব হিসেবে তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে। এ প্রসঙ্গে মশহুর মুহাদ্দিস ও উর্দু কবি মওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.)-এর (প্রাক্তন প্রধান মুহাদ্দিস, দারুল উলুম আলিয়া, চন্দনপুরা, চট্টগ্রাম) একটি কবিতা উদ্ধৃতির উপযোগীতা রাখে। মওলানার শানে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,
বহুত রো’তা হুঁ দুনিয়ামে নেহী হ্যায় আদমী বাকি,
পড়া ম্যায় খানা আব খালী নেহী উছ সে কুঈ সাকী।
কোয়ে হেঁ আনজাহানী সব ন চিশতী হেঁ ন গজ্জালী,
ফকত এক রাজধাঁনু মে ওলী আহমদ ওলী বাকী।
বাংলা ভাষান্তরে:
অশ্রু অনেক ফেলেছি এ ভবে
কোনো লোক নেই বাকী,
পানশালা আজ খালী পড়ে আছে
নেই তাতে কোনো সাকী।
হারিয়েছে সেই বাদশাহী সব
নেই যে চিশতী, নেই আজ গাজ্জালী;
রহস্য নিগড়ে বাকী আছে শুধু
ওলী আহমদ ওলী। (ভাষান্তর: জহুর–উশ–শহীদ) (চলবে)