আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সনামধন্য মুহাদ্দিস ক্ষণজন্মা মনীষী
আল্লামা হাফেজ আমীর হোসাইন (মীর সাহেব) (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
প্রারম্ভিকা
শায়খুল হাদীস আল্লামা আমীর হোসাইন (মীর সাহেব রহ.) একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ও প্রথিতযশা মনীষী ছিলেন। তিনি তাঁর ইলমী গভীরতা ও দীনী পাণ্ডিত্বের মাধ্যমে অসংখ্য যোগ্য আলেম ও প্রাজ্ঞ হাদীস বিশারদ তৈরি করেছেন। তিনি উন্নত চরিত্র ও নীতি আদর্শের মাধ্যমে অগণিত খোদাপ্রেমিক আদর্শ মানুষ তৈরি করেছেন। এ মহা মনীষী আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর পূর্বে। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক লেখা-লেখি হয়েছে। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। অনেকেই তাঁর মৃত্যুতে উর্দু-আরবি ভাষায় শোকগাথা লিখেছেন। আমাদের জামিয়া পটিয়ার বর্তমান পরিচালক আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বুখারী (হাফিযাহুল্লাহ) দুঃখভরা, বেদনাকাতর শোকগাথা লিখেছেন। জামিয়ার অনেক শিক্ষকমণ্ডলি, ফাযেল ও শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন ভাষায় শোকগাথা লিখেছেন। সেসব শোকগাথাকে একত্রিত করে জামিয়ার তৎকালিন কবিতা ও সাহিত্যচর্চা বিভাগ শোবায়ে মুশাআরার যিম্মাদার ও শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ আইয়ুব (রহ.) যিকরে আমীর নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। তিনি শুরুতে একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন। সেখানে মীর সাহেব (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনা করেছেন। তেমনি জামিয়া পটিয়ার কৃতী সন্তান জামিয়া দারুস সুন্নাহ হ্নীলার শায়খুল হাদীস, প্রখ্যাত কবি আল্লামা হানিফ রাগিব (হাফিযাহুল্লাহ) আমীরুল আওলিয়া কা মুখতাসার তাযকারা শীর্ষক উর্দু ভাষায় একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। শুনেছি, এ সবগুলোকে সামনে রেখে জামিয়া পটিয়ার অন্যতম কৃতী সন্তান ও বর্তমান জামিয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আল্লামা ফুরকানুল্লাহ খলীল (হাফিযাহুল্লাহ) একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার কিছু অংশ জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রামের মুখপাত্র মাসিক আল-হকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আশা করি অতিশীঘ্রই তা পরিপূর্ণ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে এবং দেশ ও জাতি তা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, ইনশা আল্লাহ।
কিছু দিন পূর্বে আনোয়ারা থানার আলোকিত মনীষীদের জীবনী সংগ্রহের একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মদ আমীর হোসাইন (রহ.)-এর নামটিও খুবই সম্মানের সাথে স্থান পায়। তাই আমরা আমাদের সাধ্য মতে তাঁর কৃতি ও স্মৃতি সংগ্রহের ধারা অব্যাহত রেখেছি। তাঁর অসংখ্য শিষ্য এখানো জীবিত আছেন। তাঁর সন্তান-সন্ততির অনেকেই অত্যন্ত সুনামের সাথে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত হযরতের সাহেবযাদা জামিয়া পটিয়ার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব (হাফিযাহুল্লাহ) হযরতের শেষ সময়ের সঙ্গী ছিলেন। তিনি হযরত মীর সাহেব (রহ.) সম্পর্কে অনেক উপকারী তথ্য প্রদান করেছেন, যার ভিত্তিতে এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত পরিচিতি
নাম: মুহাম্মদ আমীর হোসাইন। জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.) তাঁকে অত্যাধিক ভালবাসতেন। তিনি মহব্বত করে তাঁকে ‘মীর সাহেব’ বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে এই মীর সাহেব নামেই তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন। তবে তাঁর নিজ এলাকায় তিনি ‘ফকীর মাওলানা’ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার কারণ হলো, তিনি যখন দেওবন্দ থেকে বাড়ি ফিরে ছিলেন, তখন খুব বেশি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। সব সময় মসজিদে অবস্থান করতেন। তাই মানুষ তাঁকে আল্লাহঅলা হিসেবে জানতেন। আর যেহেতু ‘ফকীর’ শব্দটি আল্লাহঅলা অর্থে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু তাঁকে ‘ফকীর মাওলানা’ বলা হতো। তখন থেকে তিনি ‘ফকীর মাওলানা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
তাঁর পিতার নাম জনাব আবদুর রউফ এবং দাদার নাম মাওলানা আমীরুযযামান। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্ব কনিষ্ট। তাঁর বড় ভাই আল্লামা ইসমাঈল (রহ.), যিনি আল-জামিয়া আল-আরবিয়া জিরির সিনিয়র মুহাদ্দিস ও পরবর্তীতে জামিয়া মোজাহের উলুমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং হযরত মীর সাহেব (রহ.)ও জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-সহ অসংখ্য আলেমের আদর্শ শিক্ষক ছিলেন।
মীর সাহেব (রহ.)-এর এক বোনকে শাদি দেওয়া হয়েছে মাওলানা নুরুল আলম (রহ.)-এর সাথে। মাওলানা নুরুল আলম (রহ.) একজন প্রাজ্ঞ আলেমে দীন ছিলেন। তিনি জিরি মাদরাসাসংলগ্ন কাজী বাড়িতে জন্মলাভ করেন। আল-জামিয়া আল-আরবিয়া জিরিতে অত্যন্ত সুনামের সাথে পাঠ্য জীবন সমাপ্ত করে দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদীস সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগের প্রথম স্থান অধিকার করে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে আল-জামিয়া আল-আরবিয়া জিরিতে দক্ষতার সাথে তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন এবং সেখানে তিনি শায়খুল আদব হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বংশ পরিচয়
খন্দকার (خواندکار) ফারসি শব্দ। ফারসি ভাষার (خواندن) ক্রিয়ামূল; যার অর্থ হলো ‘পড়া’, এবং ফারসি ভাষায় کردن (কার্দন) ক্রিয়ামূল; যার অর্থ করা, সুতরাং এই দুটি শব্দ মিলিত হয়ে ‘পাঠ দানকারী’ শিক্ষক অর্থ বোঝায়। কারো মতে খন্দকার শব্দটি ফারসি খোদাওয়ান্দগার (خداوندگار) ফারসিশব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। খন্দকার বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমাদের মুসলিম সমাজে শিক্ষক হিসেবে খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায়। হযরত মাওলানা মীর সাহেব (রহ.) ছিলেন খন্দকার বংশের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী উপজেলা আনোয়ারা থানার অন্তর্গত চাতরী ইউনিয়নের রুদূরা গ্রামে আনুমানিক ১৩২৯ হিজরী মোতাবেক ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা-দিক্ষা
হযরত মীর সাহেব (রহ.) ছিলেন একটি শিক্ষিত পরিবারের সুসন্তান। তাই প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা তিনি পারিবারিকভাবেই অর্জন করেন। অতঃপর তাঁরই সুযোগ্য বড়ভাই জিরি মাদরাসার সাবেক সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা ইসমাঈল (রহ.) তাকে আল-জামিয়া আল-আরবিয়া জিরিতে ভর্তি করে দেন। তখন জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.) জিরি মাদারাসার শিক্ষক এবং মুফতি সাহেব (রহ.) ছিলেন মাওলানা ইসমাঈল (রহ.)-এর প্রিয় ছাত্র। তাই তাঁর আপন ছোট ভাই (মীর সাহেব রহ.)-কে পূর্ণ নেগরানির দায়িত্ব অর্পণ করেন। হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর স্নেহ-মমতা ও পূর্ণ তত্ত্বাবধানে ‘আল-জামিয়া আল-আরবিয়া জিরি’-এ দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। মুফতি সাহেব (রহ.) তাঁকে বিশেষ নেগরানীতে রাখতেন। পড়া-লেখার তত্ত্বাবধান করতেন। আখলাক-চরিত্রের নেগরানি করতেন। সদুপদেশ ও সুপরামর্শের মাধ্যমে তাকে পরিচালিত করতেন। তাই খুবই সুনামের সাথে জিরি মাদরাসায় শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে সামর্থবান হয়েছিলেন। তিনি মুফতি সাহেব (রহ.)-এর নেগরানির কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলতেন, হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) আমাকে এমনভাবে নেগরানি করতেন যে, একদিন আমি রুমের বাইরে নির্জন জায়গায় হারিকেন নিয়ে পড়তে গেলাম। পড়া অবস্থায় সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম। যথা সময়য়ে আমাকে রুমে না দেখে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) তালাশ করার জন্য রুম থেকে বের হয়ে যান। তখন তিনি দেখলেন, আমি হারিকেন জ্বলাবস্থায় সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছি। তখন তিনি সেখানে গিয়ে বললেন, আমীর হোসাইন! তুমি ঘুমাচ্ছো? এই শব্দ আমার কানে পড়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে গেলাম। হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব বলেন, আব্বাজান মুফতি সাহেব (রহ.)-এর এ ঘটনাটি বলে প্রায় সময় কেঁদে দিতেন।
জিরি মাদরাসায় শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে উপমহাদেশের ইলমে ওহির প্রাণ কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করলেন। সেখানে দাওরায়ে হাদীসের পুনঃপাঠ গ্রহণ করেন।
শিক্ষকমণ্ডলি ও আধ্যাত্মিক সাধনা
দারুল উলুম দেওবন্দে তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলির মধ্যে রয়েছেন, শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), শায়খুল আদব হযরত মাওলানা এজাজ আলী (রহ.), হযরত মাওলানা শামসু হক আফগানী (রহ.)-সহ তৎকালিন দারুল উলুম দেওবন্দের সমসাময়িক বড় বড় মুহাদ্দিসগণ।
আর দেশে তাঁর উল্লেখযোগ্য আসাতেযায়ে কেরাম ছিলেন, হযরত মীর সাহেবর (রহ.)-এর আপন বড় ভাই, জামেয়া মোজাহেরুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা ইসমাঈল (রহ.), শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল ওয়াদূদ সন্দীপী (রহ.), জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মুফতি আযীযুল হক (রহ.), জামিয়া আরবিয়া জিরির সাবেক নাজেম সাহেব আল্লামা আবুল খায়ের (রহ.), জামিয়া আরবিয়া জিরির সাবেক দ্বিতীয় শায়খুল হাদীস আল্লামা সালেহ আহমদ সাহেব (রহ.) প্রমুখ।
তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে পড়া-লেখা সমাপ্ত করে আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশ্যে খানাকাহে ইমদাদিয়া থানাভনে গমন করেন। সেখানে হযরত হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। সেখানে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। সেই ছয় মাসেই পূর্ণ কুরআন মজিদের হিফজ সমাপ্ত করেন। অতঃপর ইলমে যাহেরী ও ইলমে বাতেনীর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে দেশে গমন করেন। পরবর্তীতে জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর দিক-নির্দেশনায় আধ্যাত্মিক সাধনা করে তাঁর কাছ থেকে খেলাফত ও ইজাযতপ্রাপ্ত হন।
তাঁর খলীফাগণ
হযরত মীর সাহেব (রহ.) আধ্যাত্মিক জগতে অনেক কাজ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে মানুষ অনেক উপকৃত হয়েছেন। তাঁর হাতে অনেক বড় বড় আলেমগণও বায়আত গ্রহণ করেন এবং আত্মশুদ্ধির কাজ চালিয়ে যান। আধ্যাত্মিক সাধনা করে অনেকই তাঁর কাছ থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, মাওলানা হানিফ রাগেব (হাফিযাহুল্লাহ), শায়খুল হাদীস, জামিয়া দুরুসসুন্নাহ, হ্নীলা। মাওলানা মাহবুবুর রহমান আরকানী (হাফিযাহুল্লাহ)। তিনিও বর্মায় ‘পীর সাহেব’ নামে খ্যাত। তিনি সেখানে বায়আত-মুরীদের ধারা অব্যহত রেখেছেন।
কর্মজীবন
হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর কর্মজীবনের সূচনা হয়েছিল রাঙ্গুনীয়া থানাধীন শরফভাটা মু’আবিনুল ইসলাম মাদরাসায় শিক্ষাকতার মাধ্যমে। তিনি সেখানে কিছুদিন অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেন।
মুহাদ্দিস হিসেবে
জামিয়া পটিয়ায় যোগদান
এ দিকে জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযীযুল হক সাহেব (রহ.)-কে তাঁর অনেক বন্ধু-বান্ধব ও সাথী-সঙ্গীরা জামিয়া পটিয়ায় দাওরায়ে হাদীস চালু করার জন্য অনুরোধ করেন। তারা বলেন, ‘প্রতি বছর জামিয়া পটিয়া থেকে অনেক ছাত্র মিশকাত শরীফের পাঠ সমাপ্ত করে চলে যায়। অন্য জামিয়াতে গিয়ে তাদেরকে দাওরায়ে হাদীস পড়তে হয়। এখানও সবকিছুর যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। তাই এখানেও দাওরায়ে হাদীসের দরস চালু করা উচিত।’ কিন্তু মুফতি সাহেব (রহ.) স্বভাবজাত বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, আমি নিজের অযোগ্যতা ও হাদীস শাস্ত্রের কিতাবাদি ও বিভিন্ন সহায়ক ব্যাখ্যাগ্রন্থাদির অভাব দেখিয়ে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি।
ইত্যবসরে একরাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, অজু করতে করতে সময় চলে যাচ্ছে, নামায শুরু করতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। হযরত আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী (রহ.) সেই সময় হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন। আমি তাঁর নিকট স্বপ্ন বর্ণনা করলে তিনি বলেন, ‘দাওরায়ে হাদীসের দরস আরম্ভ করে দেওয়া উচিত। এ স্বপ্নের পর আমারও মনে হলো যে, নাহু-ছরফসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলির পাঠদানে সময় চলে যাচ্ছে এবং হাদীস শরীফের খেদমত শুরু করতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাই আল্লাহর তরফ থেকে সতর্কতা এসেছে। তবে আমি এ ব্যাপারে নিজের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার অনুযোগ করলে হযরত ইবরাহীম বলিয়াভী (রহ.) আমাকে অভয় দিলেন। তিনি বলেন, আমি নিজে উপস্থিত হয়ে দাওরায়ে হাদীসের সবক শুরু করে দেবো। অবশেষে তা-ই হলো। কিছু ছাত্রকে দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী (রহ.) দাওরায়ে হাদীসের দরস আরম্ভ করেন।
এখন দাওরায়ে হাদীসের কিতাবাদি পাঠদান করার জন্য যোগ্য মুহাদ্দিসের প্রয়োজন। তখন হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর আপন হাতে গড়া শিষ্য আল্লামা আমীর হোসাইন (রহ.)-কে জামিয়া পটিয়ায় সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি জামিয়ায় নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই তিরমিযী শরীফের দরস প্রদান করে আসছেন। তিনি জামিয়া পটিয়ার একজন সফল শিক্ষক ও সার্থক মুহাদ্দিস। শিক্ষার্থীরা যে কোন কিতাব তাঁর কাছে পড়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কারণ, মতন বা মূল টেক্সট থেকে মর্মোদ্ঘাটনে এবং তা অভিনব পন্থায় উপস্থাপনে তাঁর জুড়ি পাওয়া মুশকিল ছিলো। তাই দরসে নিযামীর কঠিন থেকে কঠিন কিতাবাদি তিনি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করতেন। তাই জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত দরসে নিযামীর সর্বোচ্চ কিতাব বুখারী শরীফ ও তিরমিযী শরীফের সফল ভাষ্যকার হিসেবে দীনের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষত তিনি খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে বুখারী শরীফ প্রথম খণ্ডের যথোপযুক্ত দরস প্রদান করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহ তাঁর খেদমতগুলো কবুল করেন ও উত্তম বিনিময় দান করেন, আমীন।
তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্ররা
তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন, জামিয়া পটিয়ার সাবেক মুহতামিম আল্লামা নুরুল ইসলাম কদীম (রহ.) ও আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী (রহ.), জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী (হাফিযাহুল্লাহ), জামিয়ার পটিয়ার বর্তমান মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বুখারী (হাফিযাহুল্লাহ)। জামিয়ার পটিয়ার সাবেক শায়খুল হাদীস আল্লামা আইয়ুব (রহ.) ও মাওলানা মুফতি মুজাফফর আহমদ (রহ.), প্রফেসর ড. রশীদ, মাওলানা লোকমান আরকানী, জামিয়া পটিয়ার অন্যতম মুফতি ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া ও আল্লামা আমীনুল হক এবং জামিয়া দারুসসুন্নাহ হ্নীলার শায়খুল হাদীস মাওলানা হানীফ রাগেব (হাফিজাহুমুল্লাহ)-সহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য শীর্ষ আলেম-ওলামা।
বিয়ে-শাদি
পটিয়া থানার অন্তর্গত ৪নং ওয়ার্ডের মাঝের ঘাটা নিবাসী মাওলানা হামিদুর রহমান (রহ.) ছিলেন হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর বড় ভাই মাওলানা ইসমাঈল (রহ.)-এর শ্বশুর। মাওলানা হামিদুর রহমান (রহ.) চট্টগ্রাম মুহসিনিয়া মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। ওই মাদরাসায় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন চন্দনাইশ থানার অর্ন্তগত জোয়ারা নিবাসী মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.)। মাওলানা হামিদুর রহমান (রহ.) ছিলেন একদিকে হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর তালই, অপরদিকে মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) এর শিক্ষক। তাই তিনি উভয়ের বংশীয় আভিজাত্য ও খান্দানি ঐতিহ্য এবং পারিবারিক অবস্থা ভালোভাবেই জানতেন। এ জন্য তিনি নিজেই হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর স্ত্রী হিসেবে মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.)-এর সুযোগ্য কন্যা ‘জাহানারা বেগম’-কে অধিক উপযুক্ত মনে করলেন। তাই তিনি নিজেই প্রস্তাব দিয়ে বিবাহের বিষয়টি চুড়ান্ত করেন। উল্লেখ্য যে, মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) একজন দক্ষ ও প্রাজ্ঞ আলেমে দীন ছিলেন এবং আল্লাহঅলা একজন বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যদিও তাঁর খান্দান দেওবন্দী ঘরানার ছিলো না, কিন্তু তাদের বংশীয় আভিজাত্য ও সামাজিক ঐতিহ্য এবং পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতা সকলের নিকট সমাদৃত ছিলো।
হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর বিয়ে অনুষ্ঠান শীর্ষ আলেমগণের উপস্থিতে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষত ছয়জন আকাবির ওলামায়ে কেরামের উপস্থিতে তাঁর শুভ আকদ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, জামিয়া আরবিয়া জিরির প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হযরত মাওলানা আহমদ হাসান (রহ.), তাঁর আপন বড় ভাই জামিয়া মোজাহের উলুমের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা ইসমাঈল (রহ.) এবং জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)। উক্ত অনুষ্ঠানে এমন শীর্ষ আকাবিরের উপস্থিতির কথা শুনে সকলে আনন্দিত হলেও মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.)-এর খান্দানের অনেকেই তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি, বরং তারা এ সকল আকাবিরকে ‘ওয়াহাবী’ বলে অপপ্রচার করলেন। এমনকি তারা বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে চলে যায়। যার কারণে বিয়ে অনুষ্ঠানে হযরত মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) ও তাঁর সহধর্মিনী ব্যতীত অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো না। হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর শ্বশুর মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) একদিকে সমাজ ও পরিবারের এমন হীন আচরণে ক্ষুদ্ধ হলেও ছয়জন আকাবির ওলামাসহ মেহমানদেরকে উপস্থিত পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। তাঁদের উপস্থিতিতে তিনি ছয়শত টাকা মহর ধার্য্য করে নিজ কন্যার শুভ আকদ সম্পন্ন করেন। অতঃপর কন্যার অনুমতি সাপেক্ষে ছয়জন আকাবির ওলামায়ে কেরামের সম্মানার্থে সেই ছয়শত টাকা মহর মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা প্রদান করেন।
সন্তান-সন্ততি
মৃত্যুকালে হযরত মীর সাহেব (রহ.) সাত ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। সকল ছেলে-মেয়েকে তিনি দীনী শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তুলেছেন। তাঁর সকল সন্তান পবিত্র কুরআনের হাফেজ ও দক্ষ আলেম হয়েছেন। প্রথম সন্তান হাফেজ মাওলানা আবদুর রহমান (রহ.)। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ চন্দ্রঘোনা ইউনুছিয়াসহ কয়েকটি মাদরাসায় খেদমত করেন। দ্বিতীয় সন্তান হাফেজ মাওলানা কাসেম (রহ.)। তিনি জামিয়া পটিয়ার মুহাদ্দিস ও ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি জীবনের শেষ মুর্হূত পর্যন্ত জামিয়া পটিয়ায় তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতে পরিণত করেন, আমীন। তৃতীয় সন্তান হাফেজ মাওলানা মাহমূদুল হাসান। তিনি দোহাজারী মাদরাসা ও হাইলধর মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হলেন, হাফেজ মাওলানা হোসাইন। তিনি চট্টগ্রাম মোজাহেরুল উলুম মাদরাসা ও মহেশখালী গোরকঘাটা মাদরাসায় খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে বার্ধক্য অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করছেন। পঞ্চম সন্তান হলেন, হাফেজ মাওলানা শোয়াইব। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জামিয়া পটিয়ার হিফজ বিভাগে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। ষষ্ঠ সন্তান হলেন, হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ। তিনি বর্তমানে আনোয়ারা আযীযীয়া এমদাদুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। সপ্তম সন্তান হলেন, হাফেজ মাওলানা ওমর ফারুক। তিনি বর্তমানে ‘জামিয়া ওয়াহেদিয়া বোয়ালখালী’-এর শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর দুই মেয়ের প্রথম জনের নাম যোবাইদা ও অপরজনের নাম মারজিয়া।
মীর সাহেব (রহ.)-এর পরিবার আনোয়ারা থানার একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার। তারা দেশ ও সমাজের কুসংস্কার রোধে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে আলোকিত সমাজ বিণির্মানে তাঁদের পরিবারের ভূমিকা ঈর্ষণীয়। তাঁদের অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে পরকালের যাত্রী হয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের সকলকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করেন। আর যারা আছেন, তাঁদেরকে দীন ও জাতির খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দান করেন, আমীন।
সন্তানদের তা’লীম-তরবিয়ত
হযরত মীর সাহেব (রহ.) সন্তান-সন্ততিকে তা’লীম-তরবিয়তের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করতেন। সন্তানদেরকে সময় দিতেন। তাদেরকে কাছ থেকে কুরআন মজীদ শুনতেন। রমযান মাসে নফল নামাযে সন্তানদের কাছ থেকে তিলাওয়াত শুনতেন। রমযানের পূর্বে সকল সন্তানদেরকে বসিয়ে কুরআন মজীদ পড়ার ব্যবস্থা করতেন। হযরতের সকল সন্তান যেহেতু হাফেজ ছিলেন, তাই তাদেরকে রমযানের তৈরি হিসেবে এই সময়টিকে কাজে লাগাতেন। তিনি কুরআন মজীদ পড়ার ফযীলত বর্ণনা করতেন। তিনি বলতেন, কুরআন মজীদের প্রতি হরফে দশটি করে নেকী পাওয়া যায়। সুতরাং বারবার পড়তে থাকো। যত পড়বে, তত নেকী পাবে। একজন ছোট ছেলের কোমল হৃদয়ে এই ফযীলতপূর্ণ কথাটি অবশ্য রেখাপাত করতো। তাই হুযুরের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, আব্বুর এমন কথাগুলো আমাদের অন্তরে খুবই রেখাপাত করতো। আমরাও সদা তিলাওয়াত করার চেষ্টা করতাম।
ছুটির সময়কে কাজে লাগানো
হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, যখন মাদরাসার ছুটি হতো, আমরা সবাই বাড়িতে অবস্থান করতাম। আব্বুও আমাদের সাথে বাড়িতে থাকতেন। তখন তিনি ছুটির সময়গুলো কাজে লাগানোর জন্য আমাদের পূর্ণ তত্ত্বাবধান করতেন। ফজরের নামাযের পর মাসনুন দুআ ও কুরআন তিলাওয়াত করতে নির্দেশ দিতেন। অতঃপর সকলকে কৃষি কাজ করার জন্য জমিতে পাঠিয়ে দিতেন। সেখানে আমরা ধান রোপন করার জন্য মাঠ তৈরি করতাম। আমাদের তৈরিকৃত জমিতে যখন পানি সেঁচ করা হতো এবং ধান রোপন করা হতো, তখন তাতে অধিকহারে ফসল উৎপাধিত হতো। কারণ, ট্রাকটার কিংবা মেশিনে জমি তৈরি করা আর কোদাল দিয়ে কষ্ট করে মাঠ তৈরি করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই আমাদের জমি খুব ভালোভাবেই তৈরি হতো। অতএব, আমাদের জমিতে ফসলও অধিক পাওয়া যেতো। আমরা যখন জমিতে কাজ করতে নামতাম, তখন আমাদের সাথে আব্বু নিজেও কোদাল নিয়ে অংশ গ্রহণ করতেন। আশ্চর্য লাগতো, যে লোকটি জামিয়া পটিয়ার দরসে হাদীসের মসনদে বসে হাদীসের অপূর্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন, তিনি-ই কৃষি জমিতে খাঁটি কৃষকের ভূমিকা পালন করছেন এবং সফল কৃষক হিসেবে আমাদেরকে দিক-নিদের্শনা দিচ্ছেন!
এভাবে তিনি আমাদের ছুটির সময়গুলোকেও কাজে লাগাতেন। আমাদের নামায-কালামের ব্যাপারে খবরা-খবর রাখতেন। অতিরিক্ত সময়গুলোকে পারিবারিক কাজে ব্যয় করার তাগিদ দিতেন এবং তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতেন।
পবিত্র কুরআনের প্রতি
তাঁর প্রীতি ও ভালবাসা
তিনি একজন কুরআনের সত্যিকারের প্রেমিক ছিলেন। শিশুকালে কুরআন হিফজ করার সুযোগ হয়নি। তবে কুরআনের প্রতি তাঁর অসাধারণ ভালবাসা ছিলো। তিনি সদা কুরআন শরীফ পাঠ করতেন। একসময় তিনি একজন দক্ষ হাফেজ হয়ে গেলেন। তবে তিনি অলৌকিকভাবে হাফেজ হয়েছেন। গতানুগতিক কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে নয়, বরং আলেম হওয়ার পর মাত্র ছয় মাসে নিজে নিজেই হিফজ সমাপ্ত করেন। দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশ্যে ‘খানাকায়ে এমদাদিয়া’-এ গমন করেন। সেখানে হযরত থানভী (রহ.)-এর সুহবতে ছিলেন। আর সেখানে থেকেই পূর্ণ কুরআন মজিদের হিফজ সমাপ্ত করেন।
একাই তারাবীহ নামাযে
খতমে কুরআন
তিনি তখন জামিয়া পটিয়ার মুহাদ্দিস। জামিয়ায় তখনো হাফেজে কুরআনের সংখ্যা বেশি ছিলো না। তাই তিনি জামিয়ার জামে মসজিদে একাই খতমে তারাবীহ পড়াতেন। অন্য কোন ‘সামে’ (সহযোগীও) থাকতো না।
জামিয়া পটিয়া থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত তখনও গাড়িতে যাতায়তের ব্যবস্থা ছিলো না। পায়ে হেঁটে যাতায়ত করতে হতো। ৮/১০ মাইলের এ দীর্ঘ পথ তিনিও পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতেন। তিনি হাঁটতেন আর তিলাওয়াত করতেন। আবার কখনো নৌ পথে গেলে, তখনও নৌকায় বসে তিলাওয়াত করতেন।
তিনি বলতেন, হাফেজ ও গায়রে হাফেজের পার্থক্য তো এখানেই যে, হাফেজ তিলাওয়াত করতে কুরআন শরীফের প্রয়োজন হয় না, অজুর প্রয়োজন হয় না। না দেখেও পড়তে পারে। হাঁটা-চলা অবস্থায়ও কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে।
হযরত মীর সাহেব (রহ.) বৃদ্ধ বয়সেও নামায ও নামাযের বাইরে নিয়মিত তিলাওয়াত করতেন। হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব বলেন, তিনি একদিন এক বৈঠকে ছয় পারা তিলাওয়াত করলেন। অতঃপর বললেন, এখন তো অত বেশি তিলাওয়াত করতে পারি না। দুর্বলতা পেয়ে বসেছে। তবে অনেক সময় নিজেকে বাধ্য করে ভালো কাজ চালিয়ে যেতে হয়। নফসকে বাধ্য করে পূণ্যের কাজ করতে হয়।
তিনি বলতেন, সর্বাবস্থায় তিলাওয়াত ও যিকর করার বিশেষ উপকার হলো, যে রাস্তা দিয়ে তিলাওয়াত ও যিকর করে পথিক চলে, সে রাস্তা অন্য রাস্তার ওপর গর্ববোধ করে এবং ওই রাস্তা কিয়ামতের দিন যিকরকারী ও তিলাওয়াকারীর পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তাই সর্বাবস্থায় তিনি তিলাওয়াত ও যিকরে লিপ্ত থাকতেন। এমনকি নৌকায় আরোহিত সাধারণ লোকজন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বি মানুষের সামনেও তিলাওয়াত করতে তিনি সংকোচবোধ করতেন না। তিনি আপন গতিতে তিলাওয়াত ও যিকর করতেন এবং মহান আল্লাহর স্মরণে কান্না করতেন। কে কি বলছে? এগুলোর প্রতি তার কোন ভ্রক্ষেপ ছিলো না। যেন আল্লাহর জন্য তিনি উম্মাদ হয়ে গেলেন।
মূলতঃ এমন পরিস্থিতি আল্লাহঅলাদের হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এমনভাবে আল্লাহর যিকর করতে বলেছেন,
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ، عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ أَنَّهُ قَالَ: «أَكْثِرُوْا ذِكْرَ اللهِ حَتَّىٰ يَقُوْلُوْا: مَجْنُونٌ».
رواه أحمد
‘হুযুরে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, এত বেশি পরিমাণ আল্লাহর যিকর করতে থাক, যেন লোক তোমাকে পাগল বলতে থাকে।’ (মুসনদে আহমদ: 11674)
অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘এত বেশি যিকর করতে থাক, যেন মুনাফিকগণ তোমাকে রিয়াকার হিসেবে আখ্যা দেয়।’
ফায়েদা: এই হাদীস দ্বারা বোঝা গেল যে, মুনাফিক এবং বেওকুফ লোক যদি যিকরকারীকে রিয়াকার এবং পাগল বলে তবুও যিকর হতে বিরত থাকবে না; বরং এত বেশি গুরুত্ব সহকারে যিকর করতে থাকবে, যেন বাস্তবেই লোকে পাগল বলে এবং পাগল তখনই বলা হয়, যখন খুব বেশি ও জোরে জোরে যিকর করা হয়, আস্তে আস্তে যিকর করলে কেউ পাগল বলে না। (ফাজায়েলে জিকির, পৃ. ২৯৭)
হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, আব্বুর ইন্তিকালের পর বাড়ি যাওয়ার পথে আমাকে এক হিন্দু বৃদ্ধা বলেন, তোমার সাথে যে বৃদ্ধ লোকটি কেঁদে কেঁদে যেতেন, ওনি কি তোমার আব্বু? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, ওনি কোথায়? ইদানিং তাঁকে দেখা যায় না কেন? আমি বললাম, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন ওই বৃদ্ধা অনেক আফসোস করলেন এবং বললেন, তিনি তো খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।
জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা হাফেজ ফুরকান মাহবুব (রহ.) আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা ইলমী ও আমলী অনেক উপকৃত হয়েছি। তিনি আমাদেরকে মীর সাহেব (রহ.)-এর বিভিন্ন স্মৃতি শুনিয়ে নসীহত করতেন। মাওলানা ফুরকান মাহবুব সাহেব (রহ.) কখনো কখনো আমাদেরকে তিলাওয়াতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে মীর সাহের (রহ.)-র উদাহরণ দিতেন। হযরত বলতেন, মীর সাহেব (রহ.) বাড়ি থেকে বের হয়ে মাদরাসায় পৌঁছা পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। তিনি ছিলেন কুরআনের প্রকৃত ভক্ত ও সত্যিকারের আশেক। কুরআনের তিলাওয়াত ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। কুরআনের মর্ম উদ্ঘাটন ছিল তাঁর প্রিয় ব্যস্ততা। কুরআনের চরিত্র ছিল তাঁর অন্যতম আদর্শ।
হযরত মীর সাহেব (রহ.) যেমনি নিজে কুরআনকে ভালবাসতেন তেমনি যারা সুরভিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন তাদেরকেও ভালবাসতেন। জামিয়া পটিয়ার একজন ছাত্র খুব সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। সে জামিয়ার জামে মসজিদে খতমে তারবীহ পড়াত। সুন্দর কুরআন তিলাওয়াতের জন্য হুযুর তাকে খুব ভালবাসতেন। হঠাৎ সে হুযুরকে না জানিয়ে অন্যত্র চলে যায়। পরে হুযুর জানতে পারেন যে, সে জামিয়ায় নেই। তখন আফসোস করে বললেন, ছেলেটি আমাকে না বলে চলে গেলো?
এ দিকে ছেলেটি যে মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে, সেখানে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন সে মনে করলো, হয়ত আমি হুযুরদেরকে না বলে চলে আসার কারণে আমার এ বিপদ এসেছে। অতঃপর সে জামিয়া পটিয়ায় চলে আসে। জামিয়ায় ভর্তি হওয়ার পর হুযুরের সাথে সাক্ষাত করতে যায়। তখন হুযুর জিজ্ঞাসা করেন, কে? তখন সে পরিচয় দেয়। তখন হুযুর তাকে বলল, তুমি আমাকে না জানিয়ে কীভাবে চলে গেলে? আমি তো তোকে মহব্বত করতাম, আল্লাহর কুরআন সুন্দর করে তিলাওয়াত করার কারণে। আর তুই আমাকে না বলে কেমনে চলে যেতে পারলে? এ কথাটি বলার সাথে সাথে হযরতের চোখ থেকে অশ্রু বের হয়ে গেল। তখন সে হুযুরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। অতঃপর হুযুর তার জন্য বিশেষ দুআ করেন। সে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। (চলবে ইনশাআল্লাহ)
শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম