ভাষাচর্চা গুরুত্ব ও তাৎপর্য
হাবীবুল্লাহ সিরাজ
বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর নেয়ামাতে আজিমাহর অন্যতম নেয়ামত হলো ভাষা। সবপ্রাণীদেরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে, কিন্তু মানবজাতির জন্য আল্লাহ মহান যে ভাষা দিয়েছেন তা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা।
আবার পৃথিবীর সবভাষার মাতৃভাষা মানুষের কাছে প্রিয় ও আদরণীয়।
ভাষা মনুষ্যপরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পশুপাখি ও প্রাণীকূল থেকে মানুষের স্বতন্ত্রতার অন্যতম একটি উপাদান হলো ভাষা। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের মানিত ধর্ম ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে ও দিতে বলে। ভিন্ন ভাষার প্রতি কোনোরূপ অসাধুতা ইসলাম কখনো পছন্দ করে না। আমি ইতিহাসে দেখতে পাই মহান আল্লাহ তার বিভিন্ন নবীকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। শুনুন আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা:
وَمِنْ اٰيٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَاَلْوَانِكُمْ١ؕ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّلْعٰلِمِيْنَ۰۰۲۲
‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্রতা। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আর-রুম: ২২)
আমরা মানুষ হলাম আল্লাহ তাআলার ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মনের ভাবভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য দিয়েছেন ভাষা। এই ভাষায় একজন অন্যজনের সুখ বুঝে, চিন্তা বুঝে, বুঝে চেতনা, আহ্বান বা বেদনা। একারণে আরবিতে মানুষকে বলা হয় ‘হাইওয়ানুন নাতিকুন’ তথা বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। সবভাষা আল্লাহর সৃষ্টি তাই, কোনো ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অন্যস্থানে। সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। সবারই একই পিতা বাবা আদম (আ.) ও একই মাতা হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্টি। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্তিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। কুরআনে করীমে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآىِٕلَ لِتَعَارَفُوْا١ؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ اَتْقٰىكُمْ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ۰۰۱۳
‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একপুরুষ ও একনারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি বা তাকওয়াবান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)
নবী-রাসূলদের ভাষা
সব নবীকে তার স্বজাতীয় ভাষাভাষী করে প্রেরণ করা হয়েছে। যদি শিক্ষকই বইয়ের ভাষা না জানে, সে ছাত্র পড়াবে কিভাবে? সব নবী রাসূল উম্মতের শিক্ষক ছিলেন। মহান আল্লাহ কাউকে নতুন কিতাব দিয়েছেন, কাউকে আগের নবীর কিতারে ওপর রেখেছেন। যে যে কিতাব নিয়ে এসেছেন বা যে নবী যে কিতাব অনুসরণ করেছেন সকলেই তদীয় কিতাবের ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সেই কথা আমাদের কুরআন এভাবে বর্ণনা করছে,
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهٖ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ١ؕ فَيُضِلُّ اللّٰهُ مَنْ يَّشَآءُ وَيَهْدِيْ مَنْ يَّشَآءُ١ؕ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ۰۰۴
‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি যেন তারা জাতির কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। (সূরা ইবরাহীম: ৪)
একথা থেকে বোঝা যায় যদি কোনো নবী আমাদের বাংলাদেশে আসতো, তাহলে অবশ্যই সে নবী বাংলা ভাষাভাষী হতেন।
আরবি ভাষাকে ভালবাসা
আরবি ভাষাকে ভালবাসা সব উম্মতে মুহাম্মদির জন্য জরুরি। কেননা আরবি আমার এই উম্মতের ধর্মীয় ভাষা। আর ধর্মীয় ভাষাকে মূল্যায়ন করা শিখা পড়া সবই গুরুত্বপূর্ণ। নবী করীম (সা.) বলেন বলেছেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবি ভাষাকে ভালবাসো, ১. কুরআন নাযিল হয়েছে, আরবি ভাষায়, ২. আমার ভাষা আরবি ও ৩. জান্নাতের ভাষা আরবি।’
আরবদের কাছে আরবি কিতাব আল-কুরআন নাযিল করা হয়েছে। কারণ তাদের মাতৃভাষা আরবি, অন্য ভাষায় নাযিল করলে তাদের বুঝতে এবং অনুসরণ করতে অসুবিধা হতো। মহাগ্রন্থ আল কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ¯^qs ব্যাখ্যা প্রদান করেন এভাবে,
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ قُرْءٰنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ۰۰۲
‘আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কুরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো। (সূরা ইউসুফ: ২)
ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সুন্নত
ভাষার শুদ্ধতা ও উচ্চারণরীতি মেনে চলা সুন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ। হ য ব র ল করে ভাষাকে উচ্চারণ করা ও পড়া সুন্নাহ বিরোধী ও ভাষার মান বিরোধী। আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.) ছিলেন ‘আফসাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ ভাষী। সুতরাং বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজি (সা.)-এর সুন্নত। কুরআনুল করীম ঘোষণা,
اَلرَّحْمٰنُۙ۰۰۱ عَلَّمَ الْقُرْاٰنَؕ۰۰۲ خَلَقَ الْاِنْسَانَۙ۰۰۳ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ۰۰۴
‘দয়াময় রহমান আল্লাহ! কুরআন পাঠ শেখালেন; মনুষ্য সৃজন করলেন; তাকে ভাষা বয়ান শিক্ষা দিলেন।’ (সূরা আর-রহমান: ১-৪)
শায়খ উসমান গনীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি করছি, ভাষাচর্চা ইবাদত। আরবি ভাষার ব্যাকরণ মুসলমানদের হাতেই রচিত হয়। অনারবদের কুরআন পড়তে সমস্যা হতো বিধায় হযরত আলী (রাযি.) তাঁর প্রিয় শাগরেদ হযরত আবুল আসওয়াদ আদ-দুওয়াইলী (রহ.)-কে নির্দেশনা দিয়ে আরবি ভাষাশাস্ত্র প্রণয়ন করান, যা ইলমে নাহু ও ইলমে সরফ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে উচ্চতর ভাষাতত্ত্ব ইলমে বায়ান, ইলমে মাআনি ও ইলমে বাদির উন্নয়ন ঘটে; যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আবদুল কাহির আল-জুরজানী (রহ.) ও ইমাম যামাখশারী (রহ.)। এটাতো গেল আরবি ভাষার কথা। আমাদের বাংলা ভাষাচর্চা করা আমাদের ইবাদত ও গুরু দায়িত্ব। নব্বই দশকের শুরুর দিকে এদিকে এসেছিলেন উপমহাদেশের চিন্তার রাজপুরুষ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.)। তিনি যখন এদেশের আলিমরা মাতৃভাষায় ততটা পারদর্শী নয়, তখন তিনি এই দেশের আলিমদের অনেকটা আক্ষেপ করে বললেন, আপনাদের হাতে মাতৃভাষার ডোর নেই বিধায় আপনারা পিছিয়ে আছেন। এটা ভাষা চর্চা করা আপনাদের জন্য ইবাদত।
শায়খ আবদুর রহমান আল-জামী (রহ.) পারস্যবাসী হয়েও বিশ্বের সেরা আরবি ব্যাকরণের তাত্তিক বিশ্লেষণ গ্রন্থ শারহে জামি (আল-ফাওয়ায়িদুয যিয়াইয়া) রচনা করেন, যা কাফিয়া গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম ইবনে হাজিব (রহ.) রচিত কাফিয়া গ্রন্থের ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থের আরও জগদ্বিখ্যাত বিশ্লেষণ পুস্তক রয়েছে, সুওয়ালে কাবুলী, সুওয়ালে বাসুলী, তাহরীরে চম্বট ইত্যাদি এর অন্যতম।
মাতৃভাষার সঙ্গে ধর্মীয় ভাষাকেও আমরা সমান গুরুত্ব দেবো, ইনশাল্লাহ!