মুসলিম বিশ্বের সংকট নিরসনে করণীয়
মাওলানা আবদুল মান্নান নগরী
যে মুসলিম উম্মাহ এক সময় পৃথিবীকে দেখিয়েছিল আলোর পথ, অন্ধকারময় জগৎকে ন্যায়-নীতি, ইনসাফ ও সততার প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে করেছিল আলোকিত ও উদ্ভাসিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে সুজলা-সুফলা পৃথিবীকে সাজিয়েছিল অপরূপ সাজে, কুরআনের জ্যোতি ছড়িয়ে জয় করেছিল বিশ্বকে, রোম-পারস্যের মসনদ কিসরা ও কায়সারকে পদানত করে অর্জন করেছিল বিশ্ব নেতৃত্ব, শতাব্দী থেকে শতাব্দী পর্যন্ত বীরদর্পে শাসন করেছিল বিশ্বকে, সেই জাতি আজ বিজিত ও পরাজিত হয়ে পরাধীনতার শিকলে বন্দি পশ্চিমা বিশ্বের নিকট। পশ্চিমারা কাকলাসের ন্যায় রক্ত চুষে নিচ্ছে মুসলমানদের। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মুসলিম ভূ-খন্ডগুলোকে পশ্চিমারা দখলে নিয়ে লুন্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে মুসলমানদের অফুরন্ত মূল্যবান সম্পদকে। উন্মত্ত হিংস্র হায়েনার ন্যায় ছিঁড়েফিড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে খাচ্ছে মুসলমানদের। জালিম পশ্চিমাদের ভয়াল আগ্রাসী থাবায় দিশেহারা উম্মাহ দিকপাল হারিয়ে আজ ছুটে চলছে দিগ্বিপ্রাণে। মজলুম নারী ও শিশুর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস। দেড় হাজার বছর পূর্বের সেই মজলুমানদের আর্তনাদ যেন আবারো প্রতিধ্বনি হচ্ছে আরবের মরুপ্রান্তরে। ইসলামের আবির্ভাবকালীন সময়ে আরব সমাজের মজলুম নারী ও পুরুষের আর্তনাদের ভাষাকে কতই না চমৎকারভাবে চিত্রিত করে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন কুরআনুল কারীমে। তিনি ইরশাদ করেন,
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ وَالْمُسْتَضْعَفِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَآءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ اَهْلُهَا١ۚ وَ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِيًّا١ۙۚ وَّاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِيْرًاؕ۰۰۷۵
‘তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর, এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন নেতা নির্ধারণ করে দেন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দেন।’ (সুরা আন-নিসা: ৭৪)
দেড় হাজার বছর পর ইসলামিবিশ্ব থেকে পুনরায় নির্যাতিত-নিপীড়িত পুরুষ, নারী ও শিশুদের কন্ঠে এমন আর্তনাদের বাণীই আজ শুনা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা পাশ্চাত্যের বর্বরতা আর তাদের জুলুম-অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে সর্বব্যাপি। কিন্তু বিশ্বের বিস্তৃত ভূমির কোথাও সেই পথ তারা খুঁজে পাচ্ছে না। বিভীষিকাময় এই পরিস্থিতি থেকে মুসলমানদের মুক্তির পথ অবশ্যই খোলা আছে। আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুসলমানদের বিজিত হয়ে, মজলুম ও অত্যাচারিত হয়ে এবং পরাধীনতার শিকল পরিধান করে বেঁচে থাকার জন্য এই দুনিয়াতে পাঠাননি। তিনি তাদের পাঠিয়েছেন বিজয়ী হয়ে তার দীনকে সমুন্নত রেখে এই ধরাপৃষ্ঠে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মুসলমানরা আজ তাদের নিজের ভুল আমল ও আল্লাহ বিস্মৃতি হওয়ার কারণে তাদের এই করুণ পরিণতি। আমার ধারণা মতে, এই একবিংশ শতাব্দীতে গোটা ইসলামিবিশ্ব আজ ইসলামের জন্য এক ঊর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। যা ইতোপূর্বে আমি বিশদভাবে আলোকপাত করেছি। এই মুহূর্তে মুসলমানরা যদি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয় তাহলে আমি আশাবাদী মুসলমানরা এই শতাব্দীতেই ইসলামের এই পুনরুত্থানকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে এবং পুনরুদ্ধার করতে পারবে তাদের হৃত গৌরবকে। বোধ করি আবার বিশ্ব নেতৃত্বের আসন পূনর্দখল করতে পারবে তারা। কথিত সভ্য পাশ্চাত্যদের অসভ্যতা, বর্বরতা আর জলুম অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করবে ইসলাম ও মুসলিমরা ।
আমার জ্ঞান একেবারেই সীমিত। মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ দেখানোর মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। তবুও আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও আমি ইসলামি বিশ্বের সমীপে কিছু আরজী পেশ করতেছি। আমি আশাবাদী যদি আমরা এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করি তাহলে উম্মাহর মাঝে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হবে। ঘুমন্ত জাতি আবার জেগে উঠবে। পুনরায় বিশ্বজুড়ে উড্ডীন হবে কালিমা খচিত ইসলামি পতাকা। দেড় হাজার বছর পূর্বের রোম ও পারস্যের মসনদ কেসরা ও কায়সারের ন্যায় এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমেরিকা রাশিয়ার মসনদ পদানত করে বিশ্বনেতৃত্বের আসন পুনর্দখল করতে পারবে ইসলামি সভ্যতা।
ইমানকে নবায়ন করা
বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামি উম্মাহ বিশ্বজুড়ে বিশাল এক ভূ-খন্ডের মালিক। তার রয়েছে বিশ্বশক্তির অন্যতম হাতিয়ার বিপুল পরিমাণ জনশক্তি। তার অধীনে রয়েছে পেট্রোডলারের মতো সর্বাধিক মূল্যবান প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের বিশাল মজুদ। বিপুল অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী আরব বিশ্ব। তথাপিও এই উম্মাহ বিশ্বে আজ এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশ্বদরবারে তারা আজ একেবারেই গুরুত্বহীন এক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে পশ্চিমাদের নিকট তারা বরাবরই উপেক্ষিত ও অবহেলিত। শুধু এতটুকুই নয়, ইসলামি বিশ্বের ওপর পশ্চিমাদের অব্যাহত হামলায় দিশেহারা উম্মাহ আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিপুল জনশক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি ও বিশাল ভূখন্ডের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা আজ পশ্চিমাদের খেলনার পুতুলে পরিণতি হয়েছে। পশ্চিমারা সেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক যুগে তাদের নিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার যে নিকৃষ্ট খেলার সূচনা করেছিল, ওই সময় যেভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করতো ইসলামি বিশ্বের ভাগ্য, তাদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যেভাবে নিজের পছন্দ মতো পরিবর্তন এনেছিল ইসলামি বিশ্বের মানচিত্রে, মুসলিম বিশ্বে সেই একই নীতি তারা আজো বহাল রেখেছে চলমান এই শতাব্দীতে।
আজোও তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামি বিশ্বকে। ইসলামি বিশ্বের মানচিত্রে পরিবর্তন আনয়নে আদৌ তারা কাজ করছে ঐক্যবদ্ধভাবে। তাদের আগ্রাসননীতির মাধ্যমে ইসলামি বিশ্বে ইতিহাসের ভয়াবহতম হামলা চালিয়ে মুসলিম উম্মাহর বিপুল জনসম্পদকে হত্যা করে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে উম্মাহর অফুরন্ত সম্পদকে। বর্তমানে মুসলিম জাতি মক্কা-মদীনা থেকে নয়, তারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নিউইয়র্ক, মস্কো ও বেইজিং থেকে। মুসলিম উম্মাহর আজ এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী তারা নিজেরাই। আর তাহলো, তারা তাদের মূল শক্তি ইমানকে বিক্রি করে দিয়েছে পশ্চিমাদের হাতে। তারা আজ পাপাচার-অনাচার, খুন-ধর্ষণ, জুলুম-অত্যাচার ও অবিচার এবং সকল অপকর্ম ও অপিসংস্কৃতিতে নিমগ্ন থারার দরুন তাদের ইমানে পচন ধরে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাদের থেকে উম্মাহর মূল শক্তি নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিলুপ্তি ঘটেছে। যার ফলশ্রুতিতে উম্মাহ বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে ছিটকে পরে পরিণত হয়েছে এক গোলামী জাতিতে।
বর্তমানে মুসলমানদের বিপুল জনসংখ্যা রয়েছে ঠিক, কিন্তু যে আদর্শ ও চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে এবং যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে জয় করেছিল বিশ্বকে। তৎকালীন পরাশক্তি রোম-পারস্যের সকল দম্ভ-অহংকারকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে অর্জন করেছিল বিশ্বনেতৃত্ব। মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে স্পেন থেকে চীন পর্যন্ত, ত্রিপোলি থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত উড্ডীন করেছিল ইসলামি পতাকা। শৌর্যবীর্য ও গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করে বীরদর্পে ন্যায়-ইনসাফের সাথে শাসন করেছিল বিশ্বকে, আজ সেই আদর্শের ধারক-বাহক ও ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্র্শনকারী মাসলমানদের বড়ই অভাব। তাদের সাথে আর আমাদের সাথে পার্থক্য হলো শুধু ইমান ও আমলের প্রার্থক্য। তারা ছিল ইমানে-আমলে শক্তিশালী উজ্জীবিত ও তেজদীপ্ত এক জীবন্ত উম্মাহ। আর আমরা হলাম ইমান শূন্য, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক মৃত ও প্রাণহীন উম্মাহ। তাদের দেহ ছিল, দেহের মাঝে প্রাণও ছিল। আর আমাদের দেহ আছে বটে কিন্তু তাতে প্রাণ নামক জীবন্ত সত্তার অস্তীত্ব বিদ্যমান নেই। যে নীতি-নৈতিকতা উম্মাহকে নিয়ে গিয়েছিল বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে, সেই নীতি-নৈতিকতাকে হারিয়ে উম্মাহ আজ বিশ্বে গোলামীর জিঞ্জির পরিধান করে পরিণত হয়েছে দাস জাতিতে। তারা ছিল নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন ও ইমানী শক্তিতে বলিয়ান এক সিংহের জাতি আর আমরা হলাম নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ও ইমান-আমলবিহীন অন্তঃসারশূন্য এক জড় পদার্থ।
অনেকেই আজ ইসলামের গায়ে কালিমা লেপন করে বলে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তরবারীর মাধ্যমে। একথাটি মোটেও গ্র হণ যোগ্য নয়। এটা ইসলামের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অমূলক-অবাস্তব ও বিদ্বেষমূলক প্রপাগান্ডা ছাড়া বৈকি। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করা ও কলুষিত করা এবং ইসলামের ওপর মিথ্যে অপবাদ আরোপ করাই হলো এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এই কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব সর্বদাই এই মিথ্যা অপবাদটি বিশ্বব্যাপি প্রচার করে যাচ্ছে।
তরবারী নয়, ইসলামের মূল শক্তিই হলো ইমান। এই ইমানের প্রভাবেই মুসলমানরা মাত্র অর্ধশতাব্দীর মধ্যে জয় করেছিল বিশ্বকে । যে জ্ঞান পাপী নয়, যার হৃদয় অন্তঃসারশূন্য নয়, যার চোখের দৃষ্টি এখনোও লোপ পেয়ে যায়নি, যার বিবেকে এখনোও পচন ধরেনি, সে যদি ইসলামের ইতিহাসকে খুব ভাল করে অধ্যয়ন করে তাহলে দিবালোকের ন্যায় তার নিকট এটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে নয়, বরং মুসলমানদের ইমানি শক্তি ও তার প্রভাবেই পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে ইসলাম আদৌ দিব্যি ছড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপি।
একটু বদরের যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন ও লক্ষ করুন! ওই যুদ্ধে মুসলমানরা কি জনশক্তি ও অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান ছিল? মোটেও না। ওই যুদ্ধে মুসলমানরা ছিল একেবারেই নিরস্ত্র। তারা সংখ্যায় ছিল অতি নগণ্য। তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, আর সমরাস্ত্রের মধ্যে ছিল মাত্র ২টি ঘোড়া, সত্তরটি উট ও সামান্য কটি তরবারী। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّٰهُ بِبَدْرٍ وَّاَنْتُمْ اَذِلَّةٌۚ ۰۰۱۲۳
‘আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল।’ (সূরা আলে ইমরান: ১২৩)
অন্যদিকে শত্রুপক্ষ ছিল সংখ্যায় ৯৬০ জন। সমরাস্ত্রের দিক থেকে তারা ছিল বিপুল শক্তির অধিকারী। ওই যুদ্ধে মাসলমানরা শুধু বিজয়ীই হয় নাই বরং তারা ইসলামকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। এই বদরের যুদ্ধের বিজয়ই ইসলামের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়।
উল্লেখ্য যে, উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে মুসলমানদের যে দুর্বলতার কথা বলেছেন, তা ছিল তাদের অস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যার দুর্বলতা। কিন্তু তাদের ইমান ও তাকওয়া ছিল হিমালয়ের ন্যায় দৃঢ় ও মজবুত। যার কারণে আল্লাহ তাআলা তার স্বীয় সাহায্য দ্বারা তাদের বিজয় দান করেছিলেন। কিন্তু একই মুসলমানরা যখন ইমানী শক্তি ও আল্লাহর সাহায্যের প্রতি লক্ষ্য রাখেননি, বরং তারা গর্বিত ছিলেন তাদের সংখ্যাধিক্য ও সমরাস্ত্রের আধিক্যতা নিয়ে, তখন তারাই আবার বিপর্যস্ত ও পর্যদুস্ত হয়েছিলেন চরমভাবে। যুদ্ধের ময়দানে তখন তাদের অস্ত্রশক্তি ও জনশক্তি কোনো কাজেই আসেনি। বরং অতীতের তুলনায় ওই যুদ্ধে মুসলমানরা বিপুল জনশক্তি ও অস্ত্র শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা মার খেয়েছিল চরমভাবে। আর এধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল হুনাইন যুদ্ধে। ওই যুদ্ধে মুসলমানদের অস্ত্র শক্তি ছিল বিপুল পরিমাণ। সৈন্য সংখ্যাও ছিল অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। এতদ্বসত্ত্বেও তারা সেই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে হোচট খেয়ে কিংকর্তব্যমিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। নাজেহাল, আহত ও ব্যথিত হয়ে পলায়ন করেছিল যুদ্ধের ময়দান থেকে। তার একমাত্র কারণ ছিল, তারা আল্লাহ মুখি না হয়ে বরং অস্ত্র ও জনশক্তিকেই বিজয়ের জন্য যথেষ্ট মনে করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে সেই যুদ্ধে তারা বিপর্যস্ত ও পর্যদুস্ত হয়েছিল চরমভাবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّٰهُ فِيْ مَوَاطِنَ كَثِيْرَةٍ١ۙ وَّيَوْمَ حُنَيْنٍ١ۙ اِذْ اَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْـًٔا وَّضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْاَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُّدْبِرِيْنَۚ۰۰۲۵
‘আল্লাহ তাআলা অনেক ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং হুনাইন যুদ্ধে। যখন তোমদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্য সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে তোমরা পলায়ন করেছিলে। (সূরা আত-তওবা: ২৫)
ইয়ারমুকের যুদ্ধে শত্রুর তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। যুদ্ধের সেনাপ্রধান ইসলামি বিশ্বের প্রেসিডেন্ট হযরত ওমর (রাযি.)-এর নিকট অতিরিক্ত সৈন্য চেয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। হযরত ওমর (রাযি.) প্রতিউত্তরে চিঠি পাঠিয়ে লিখেন, ‘তোমাদের পত্র হস্তগত হয়েছে। তোমরা অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেছো, কিন্তু আমি তোমাদের এমন এক সত্তার ঠিকানা দিচ্ছি যাঁর সাহায্য অধিকতর কার্যকরী এবং যাঁর সৈন্যবল অজেয়। তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। সুতরাং তোমরা তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। মুহাম্মদ (সা.) বদরযুদ্ধে তোমাদের চাইতেও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাঁর কাছ থেকে সাহায্য লাভ করেছিলেন, আমার এ পত্র পৌছা মাত্রই তোমরা শত্রু সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড় এবং আমার কাছে এ ব্যাপারে অধিক কিছু লেখার প্রয়োজন নেই।’ (মা‘আরেফুল কুরআন, পৃ. ২০১)
মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। অন্যদিকে মুসলমানদের বিপক্ষশক্তি ছিল পরাশক্তি রোম ও তাদের মিত্র আরবের অন্যান্য গোত্রসমূহ। তাদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল রোমবাহিনীর বিরুদ্ধেও মুসলমানরা সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল দূর্দণ্ডপ্রতাপ নিয়ে। এ ব্যাপারে আরো লিখতে ইচ্ছে হলেও লেখাটি অতি দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে বিধায় এখানেই ইতি টানলাম।
উপরোল্লিখিত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের শক্তি অস্ত্র ও জনবল নয়। তাদের শক্তি হলো ইমান ও তাকওয়া। মুসলমানদের ইমান যখন মজবুত ও দৃঢ় হবে তাদের মাঝে যখন পরিপূর্ণ আল্লাহর ভয় বিদ্যমান থাকবে তখন তাদের বিজয়ও সুনিশ্চিত হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সাহায্য ও সহোযোগিতাও অবধারিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ۰۰۴۷
‘মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়ীত্ব ও কর্তব্য।’ (সূরা আর-রূম: ৪৭)
কিন্তু অতি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের দুনিয়ার সবকিছুই আছে, শুধু একটি জিনিস নেই, তাহলো ইমান। আল্লাহর কাছে মুসলমানদের অর্থ, অস্ত্র ও জনশক্তি মোটেও বিবেচ্য নয়, তার নিকট গ্রহণযোগ্যই হলো একমাত্র তাদের ইমান। মুসলমানদের ইমানের দুর্বলতাই আজ তাদেরকে পরাধীনতার গ্লানী পরিয়ে দিয়েছে। আমরা যদি ইসলামি বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, আমরা যদি ইসলামি উম্মাহর ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতি তাকাই তাহলে পূর্ব পশ্চিম তথা ইসলামি সমাজ আর খ্রিষ্টান সমাজ এ দুইয়ের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করা আমাদের জন্য বড়ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজেদেরকে পশ্চিমা আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে আমাদের ইমান-আমল, নৈতিকতাবোধ ও মূল্যবোধ সবকিছুকেই বিসর্জন দিয়েছি।
আধুনিক যুগে ইসলাম অচল এবং তা সেকেলে ধর্ম এসব অপাঙতেয় ও অমূলক মন্তব্য করে দিন দিন আমরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর পশ্চিমা বিশ্বের নষ্ট ও ভ্রষ্ট সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে পশ্চিমাকরণে তোড়জোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফল যা হবার তাই হলো। আমাদের কাছ থেকে ইমান, আল্লাহ ভীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সবকিছুই হারিয়ে গেছে। আমাদের ইমানী শক্তি ও ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে গেছে। আমরা সতেজতা ও সজীবতাহীন এবং প্রাণবিহীন এক জড় পদার্থে পরিণত হয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমারা বনের একটি সিংহকে যতটা ভয় পায় মুসলিম উম্মাহকে তার সিকিয়ানাও ভয় পায় না। অথচ উম্মাহর একটি সময় এমন ছিল যে, অমুসলিমতো বটেই বনের বাঘ ও সিংহ পর্যন্ত একজন সাধারণ মুসলমানকে দেখলে ভয়ে তটস্থ হয়ে দলে দলে পলায়ন করতো। একজন সাধারণ মুসলমানের এই প্রভাব ও শক্তি অস্ত্রের কারণে ছিল না, ছিল ইমান-আমলের শক্তি ও তার প্রভাব।
বর্তমান এই শতাব্দীতে উম্মাহ যদি তাদের বিশাল জনশক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি ও সমরশক্তির পাশাপাশি তাদের ইমানকে নবায়ন করে তাদের চরিত্র ও আদর্শকে সুন্দর করে নেয়, পুনরায় সুন্দর ও সুসজ্জিত করে নেয় তাদের নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধকে, তাদের ইমান নামক বৃক্ষটিতে আমলের ফল্গুধারা প্রবাহিত করে তার মাঝে সতেজতা ও সজীবতা আনয়ন করে তাহলে অবশ্যই এই মৃতপ্রায় উম্মাহ আবার পুনরুজ্জীবিত হবে। গভীর রাতের ঘুম ভেঙ্গে নতুন করে তারা আবার জেগে উঠবে। তাদের সংকীর্ণ বক্ষ প্রশস্ত হবে এবং মরীচিকাময় অন্তর স্বচ্ছ ও পরিস্কার হয়ে তাতে প্রতিভাত হবে শক্তি-সাহস ও হিম্মত। আমি আশাবাদী এর ফলে তারা পুনরায় বিজয়ের মালা পরিধান করতে সক্ষম হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে তারা আবার বিশ্ব জয় করার মতো সফলতা ও সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে। হতে পারে তাদের জন্য আবার বিশ্ব নেতৃত্বের মুকুট পরিধান করার পথ সুগম হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْاَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ١۪ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِيْنَهُمُ الَّذِي ارْتَضٰى لَهُمْ ؕ ۰۰۵۵
‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন।’ (সূরা আন-নূর: ৫৫)
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন,
وَلَا تَهِنُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَاَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ۰۰۱۳۹
‘তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং চিন্তিত হয়ো না, যদি তোমরা মুমিন হও তাহলে তোমরাই জয়ী হবে। (সূরা আলে ইমরান: ১৩৯)
উল্লেখিত দুটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বিজয় ও তাদের বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যারা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলামি বিশ্ব ও উম্মাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্থ তাদের জন্যই হলো উপরিউক্ত আয়াত দুটি পথ নির্দেশক। অর্থাৎ আমাদের জন্য হতাশা আর চিন্তা নয়, বরং আমাদের করণীয় হলো আমাদের ইমানকে নবায়ন করে তাকে মজবুত ও দৃঢ় করা।
আমি চলমান শতাব্দীতে উম্মাহকে নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। ইসলামের এই পুনরুত্থানের যুগে আমাদের প্রধান কাজই হলো আমাদের ইমান ও আমলকে পরিমার্জিত ও পরিশুদ্ধ করে আমাদের চরিত্র ও আত্মাকে পরিচ্ছন্ন আকারে সংশোধন করা। ভবিষ্যৎ অবশ্যই এই উম্মাহর জন্য অত্যন্ত উজ্জ্বল ও আলোকিত। যদি তারা এই কাজটি যথাযথভাবে পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ইসলামের এই অগ্রগতি ও উন্নতির যুগে উম্মাহ যদি তাদের বিপুল জনশক্তিকে ইমানের বলে বলীয়ান করে তোলে তাহলে আমি কুরআনের আলোকে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলতে পারি চলমান শতাব্দীতেই উম্মাহ আবার বিজয়ের মালা পরিধান করতে সক্ষম হবে। পুনরায় তারা বিশ্ব মসনদের আসন পুনর্দখল করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি সাধন করা
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানরা বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পাশ্চাত্যের তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে, বোধকরি এটা এখন আর কারো কাছে অস্পষ্ট নয়। বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে মুসলিমদের ছিটকে পড়া এবং বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্য থেকে রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণই হলো শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে উম্মাহর পশ্চাৎপদতা। অথচ এই উম্মাহর প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশই হলো জ্ঞান আহরণ করার প্রতি। রাসূল (সা.)-এর প্রতি প্রথম ওহীই ছিল, ইকরা অর্থাৎ পড়। জ্ঞানার্জনের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ এর প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে যে, উম্মাহর সকল ক্ষেত্রে সফলতার মূল চাবিকাঠিই হলো জ্ঞানার্জন।
পশ্চিমা বিশ্ব আজ বিশ্বকে যে উপাদানের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করছে, শাসন করে যাচ্ছে সমগ্র বিশ্বকে, তার মূল কারণ হলো, বিজ্ঞান চর্চায় তাদের অসামান্য সফলতা। বিজ্ঞানে তাদের উৎকর্ষ সাধনই হলো তাদের সফলতার মূল চাবিকাঠি।
পাশ্চাত্যরা যখন নিবিড়ভাবে বিজ্ঞান চর্চায় নিমজ্জিত হলো এবং বিজ্ঞানে নিরলস গবেষণা চালিয়ে বৈষয়িক উন্নতির সফলতার চূড়ায় আরোহণ করে যাচ্ছিল, তখন আমরা এই বিজ্ঞান চর্চাকে অন্ধভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রচার করে তাকে উপেক্ষা করে চলি। এড়িয়ে যাই তার শিক্ষার্জনকে। আমরা ব্যস্ত হয়ে পরি তর্ক ও যুক্তি বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার ওপর। এরিস্টটলের দর্শনে কে কত বেশি পারদর্শী হতে পারি, তর্ক ও যুক্তি বিদ্যায় ভূতপত্তি অর্জন করে কে কারে আমরা হারাতে পারি এর ওপরই ছিল আমাদের অসম প্রতিযোগিতা।
অথচ বিজ্ঞানের এই চাকচিক্যের যুগে তর্ক ও যুক্তিবিদ্যা আমাদের কী উপকারীতা দান করেছে, আমাদের জন্য কী কল্যাণ বয়ে এনেছে? এই প্রশ্নটাই বোধ করি এখন একেবারেই গুরুত্বহীন। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, তর্ক ও যুক্তি বিদ্যায় আমাদের নিষ্ফল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা এবং বিজ্ঞান চর্চা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে ধারণা করে তাকে এড়িয়ে চলাই ছিল ইসলামি উম্মাাহর পতনের অন্যতম মূল কারণ। আমার এই কথার বিরোধিতা হয়তো অনেকেই করতে পারেন, কিন্তু আমরা যদি অন্তরদৃষ্টি দিয়ে আমাদের বিগত কয়েক শতাব্দীর জ্ঞান-চর্চার ধরণ ও তার পরিধি নিয়ে একটু গবেষণা করি তাহলে হয়তোবা আমার কথার সাথে অনেকে একমত পোষণ করতেও পারেন। আমি এতটুকু বলতে পারি, বিজ্ঞান চর্চা আদৌ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তবে হ্যা! যে বিজ্ঞানচর্চা মানুষকে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যায়, যে বিজ্ঞান মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয় সে বিজ্ঞান চর্চাকে ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। এমনকি ইসলামে তা নিষিদ্ধ বলেও আমরা জ্ঞান করি।
বিজ্ঞান হচ্ছে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা। আল্লাহ তাআলা তিনি নিজেই কুরআনুল কারীমে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিশাল আলোচনা করেছেন। যদিও কুরআনুল কারীম অতি সংক্ষেপে সকল সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েই আলোচনা করেছে কিন্তু কোনো বিষয়কেই সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। মানব জাতির সৃষ্টিতত্ত্ব, মহাকাশের সৃষ্টিতত্ত্ব, মহাশূন্যের অবস্থান ও তার আকৃতি-প্রকৃতি, বিভিন্ন প্রকারের প্রাণীর সৃষ্টিতত্ত্ব ও জমীনের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সমুদ্র ও সমুদ্রপ্রাণীর সৃষ্টিতত্ত্বসহ সকল সৃষ্টির বিষয়েই আল্লাহ তাআলা অতি সংক্ষেপে বিজ্ঞানসুলভ আলোচনা করেছেন। এমনকি আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনের একটি সূরার নাম পর্যন্ত সূরা নাহল তথা মৌপোকা নামে নামকরণ করেছেন। আর এটা সৃষ্টিকূলের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রতি উম্মাহকে নির্দেশ প্রদান করার দিকেই ইঙ্গিত বহন করে বলে আমি মনে করি।
রাসূল (সা.)-এর যুগে বিজ্ঞান তথা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার প্রচলন শুরু হয়নি। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে তার কিছুটা শুরু হলেও বিজ্ঞান হিসেবে তার গবেষণার সূত্রপাত ঘটে আব্বাসীয় আমল থেকে। আব্বাসীয় ও উমাইয়া শাসনামলে কুরআন ও হাদীস চর্চার পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, অংক, রসায়ন ও উদ্ভিদ বিদ্যা চর্চাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো। জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ধরা হতো শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। এই বিজ্ঞান সমূহের জ্ঞানার্জন করতে না পারলে ওই সময় কাউকে উচ্চশিক্ষিত বলে গণ্যই করা হতো না।
মুসলিম আন্দালুসিয়াতো ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার। ওখানেও ইসলামি পাঠশালাগুলোতে বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যা শিক্ষা দেওয়া হতো না। ওখান থেকেই বিজ্ঞানের জ্ঞান ইউরোপে পাচার হয়েছে বিদায় আজকের ইউরোপ বিজ্ঞানের এত উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। আমি এ বিষয়ে অনেক দালিলিক আলোচনা পূর্বে উল্লেখ করছি।
মুসলিম উম্মাহ যতদিন পর্যন্ত কুরআন ও হাদীস চর্চার পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চায় মগ্ন ছিল, বৈষয়িক জ্ঞানে ছিল অগাধ পারদর্শী ততদিন পর্যন্ত তারা বিশ্ব রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে ছিল অগ্রগামী। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মূল্যবান সম্পদকে কাজে লাগিয়েই তারা ওই সময় বিশ্ব রাজনীতির চালকের আসনে আসীন ছিল। আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল সমগ্র বিশ্বব্যাপি। আর যখনই মুসলিম উম্মাহ উত্তরাধিকার সুত্রে লাভ করা এই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্য অর্জন করাকে পরিহার করে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ, জৈব আরাম ও শান্তি উপভোগ এবং বিত্ত-ভৈবব অর্জনে অতি ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর ইউরোপীয়রা মুসলমানদের পক্ষ থেকে পাওয়া বিজ্ঞানের মতো অতি মূল্যবান এই সম্পদকে আনন্দের আতিসয্যে লুফে নিয়ে তাতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে অকল্পনীয় উন্নতি সাধন করলো, তখনই মুসলিম উম্মাহ পরিণত হলো এক পশ্চাৎপদ জাতিতে, আর ইউরোপীয়রা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে দখলে নিল বিশ্বরাজনীতির মঞ্চকে।
যুগের পরিবর্তনে মানুষের চাহিদা, আশা-আকাঙ্খারও পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন সাধিত হয় মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। রাসূল (সা.) ও সাহবাদের যুগ আর বর্তমান যুগকে এক করে দেখলে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না। ওই যুগের চাহিদা আর বর্তমান যুগের চাহিদা এক নয়। রাসূল (সা.) ও সাহবায়ে কেরাম বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেননি বলে আমরাও করবো না এরকম মনোবাসনা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। রাসূল (সা.) ও সাহবায়ে কেরামতো যুগের চাহিদা মোতাবেক একজনই একাধারে ইমাম ছিলেন, ছিলেন খতীব, হয়েছিলেন বিচারপতি, সমরনায়ক ও রাষ্ট্রনায়ক। আমি মনে করি, যদি বর্তমান যুগে রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকতো তাহলে বিজ্ঞানকেও তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। কারণ এটা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যতিত এই যুগ সম্পূর্ণই অচল। তাই আমাদেরকে বর্তমান যুগের ভাষা ও চাহিদা বুঝতে হবে এবং সে মোতাবেকই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। উম্মাহকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। ইসলামি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও ইসলামি বিদ্যাপিঠগুলোতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
আমি মনে করে মুসলমানরা যদি ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানেও উৎকর্ষ সাধন করে তাহলে এতে ইসলাম ও মুসলমানদের যেমন উন্নতি হবে, তেমনিভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারকেও রোধ করা সম্ভব হবে। এর ফলে বিশ্বও এই ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধময় পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ ও মুক্ত থাকবে। এক্ষেত্রে ড. মুরাদ হফম্যান এর একটি উক্তি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, Andalusia-এর ইসলামি জগত ছিল এক প্রযুক্তির জগত। এই প্রযুক্তি যখন পশ্চিমাদের কাছে চলে এলো যেমন ধরা যাক windmill-এর কথা তখন কি তার চরিত্র বদলে গিয়েছিল? আমাদের যুক্তির সদ্বব্যবহার করবার কোরআনিক আহ্বান কিন্তু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর আহ্বানও বটে। আমি এটাও বিশ্বাস করি না যে, কোনো প্রযুক্তিকে বাহ্যত খ্রিস্টিয়করণ বা ইসলামীকরণ করা যায়। সত্যিকার একনিষ্ঠ মুসলমান দ্বারা ব্যবহৃত হলে, প্রযুক্তি ক্ষতিকারক হবার কথা নয়। Islam 2000, P. 40
সুতরাং ইসলামি বিশ্বকে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, ইসলামি উম্মাহকে এগিয়ে নিতে চাইলে মুসলমানদের আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে ইসলামি বিশ্বের সরকার প্রধানদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশ্চাত্যের মোকাবিলায় একদল মুসলিম বিজ্ঞানী তৈরি করতে হবে যারা সর্বোপুরি ইসলামি উম্মাহর কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করে উম্মাহকে এগিয়ে নিতে সদা সচেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে ইরান ও তুরস্ক কিছুটা হলেও অগ্রসর। তবে সৌদি আরব সহ অনেক প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র এক্ষেত্রে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে তারা অপরাপর বিশ্ব থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে। আমি মনে করি সৌদি আরবকে এক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে এবং সেখানে বিশ্বের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মোদ্দা কথা হলো, সামগ্রিকভাবে মুসলিমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি লাভ করে পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তাহলেই বোধ করি উম্মাহ এগিয়ে যাবে।
রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতিতেও আমাদের উচ্চতর জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হতে হবে। আমরা পশ্চিমাদের তুলনায় রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানে বহুগুণে পিছিয়ে এ কথা বললে বোধকরি মোটেও অত্যুক্তি হবে না। আমরা পশ্চিমাদের রাজনীতির মারপ্যাচ মোটেও বুঝে উঠতে পারি না। যার কারণে ইসলামি বিশ্ব বারবার পশ্চিমাদের হাতে মার খাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদগণই দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক জ্ঞানে যথেষ্ট দুর্বল এবং তারা পশ্চিমাদের তুলনায় যথেষ্ট অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে। আর ইসলামিষ্ট যারা আছেন তারাও আধুনিক রাজনৈতিক জ্ঞানে অনেকটাই পিছিয়ে। কুরআন ও হাদীসের অগাধ বুৎপত্তি অর্জন করলেও বৈষয়িক জ্ঞানে তারা অনেক দুর্বল বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আর এই দুর্বলতার কারণেই ইসলামিস্টদের বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন। দেশি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাচে আটকে পড়ে তারা প্রতিনিয়ত হোঁচট খাচ্ছেন। মার খাচ্ছেন প্রতিপক্ষের হাতে। দিন দিন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছেন প্রবলভাবে। সার কথা হলো, বর্তমানে সমগ্র ইসলামি বিশ্বই আজ ইসলামের উর্বর ভূমি বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ইসলামের এই বিপুল সম্ভনাকে কাজে না লাগানোর ব্যর্থতার মূল কারণই হলো বৈশ্বিক জ্ঞানে আমাদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা।
সেই ব্যর্থতা ও দুর্বলতা থেকে আমাদের মুক্তির উপায় হলো আমাদের মধ্য থেকে এমন কতিপয় বৈষয়িক জ্ঞানে শিক্ষিত সন্তান তৈরি হতে হবে যারা আর্ন্তজাতিক রাজনীতি ও সম্পর্ক বিষয়ে বিপুল জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী হবেন। যারা রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে পশ্চিমাদের মোকাবিলায় সক্ষম হবেন। যারা ইসলামি বিশ্বের রাজনীতির জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের ওপরও অগাধ জ্ঞানার্জন করে ইসলামি বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ হবেন। যারা পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতির ষড়যন্ত্র, রহস্য ও মারপ্যাচকে উদঘাটন করে দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথ দেখাতে পারবেন। যারা পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের জাল থেকে মুক্ত করতে পারবে মুসলিম উম্মাহকে। বর্তমানে এই ধরনের বিশেষজ্ঞের বড়ই অভাব আমাদের মুসলিম বিশ্বে। আমি এক্ষেত্রে ড. মুরাদ হফম্যানের সাথে অবশ্যই একাত্মতা প্রকাশ করছি। তিনি বলেছেন, একটা উত্তর-দক্ষিণ সংলাপের জন্য প্রয়োজনীয় সুশিক্ষিত ও সুপন্ডিত মুসলিম Occidentalists বা পশ্চিমা-বিশেষজ্ঞ কোথায়।
এক্ষেত্রে আমার আবেদন হলো, আমরা যেন আমাদের বিজ্ঞ পূর্বসুরীদের অনুসরণ করি। তাদের রেখে যাওয়া দর্শন ও তত্ত্বকে যেন নতুন করে আমরা আমাদের গবেষণার পুঁজি বানাই। আমরা গাজ্জালী, ইবনে খালদুন, ইবনে তাইমিয়া ও শাহ ওয়ালীউল্লাহর দর্শন ও চিন্তার আলোকে অগ্রসর হই। তাদের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দর্শনগুলো আমরা আমাদের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করি। তারা আমাদের কাছে যতটা-না পরিচিত তার চেয়েও বেশি পরিচিত পশ্চিমা বিশ্বে এবং আমাদের নিকট তারা যতটা উপেক্ষীত পশ্চিমাদের নিকট ততটাই গ্রহণযোগ্য। পশ্চিমারা তাঁদের লিখিত বইপুস্তক অনূদিত করে অধ্যয়ন করে রাজনীতির এক বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার আহরণ করেছে। যার ফলশ্রুতিতে তারা আজ বিশ্ব রাজনীতির প্রধান খেলোয়ারে পরিণত হয়েছে।
সার কথা হলো, ইসলামি বিশ্ব উন্নতি লাভ করতে হলে তাদের মধ্য থেকে একদল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞ ইসলামিক পন্ডিত তৈরি হতে হবে, যারা উম্মাহর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। উম্মাহকে এগিয়ে নিতে সহায়তা প্রদান করবে।
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির পুনর্বিকাশ ঘটানো
পাশ্চাত্য সভ্যতা অপরাপর সকল সভ্যতার ওপর বিশেষ করে ইসলামি সভ্যতার ওপর যেভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে তার মূলে যে বিশ্বব্যাপি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ ও তার একচ্ছত্র আধিপত্য এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে একমাত্র ইসলামি সংস্কৃতিই প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সর্বত্রই সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, যে ধর্ম ও জাতিসত্তা সাংস্কৃতিক দিক থেকে যত বেশি শক্তিশালী, দৃঢ় ও মজবুত হবে বিশ্বনেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্জনে সে ততই বেশি যোগ্য ও সক্ষম হবে।
ইসলামের আবির্ভাবকালীন সময়ে পৃথিবীতে দুটি শক্তিশালী ধর্ম তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও ওগুলো জাহিলিয়্যাতের অপসংস্কৃতির প্রভাবে একেবারেই ম্লান ও ক্ষীয়মাণ ছিল। ওই সময় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমাজের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে অপসংস্কৃতির প্রবল সয়লাভ ছিল। ইসলাম আবির্ভূত হওয়ার পর বিশ্বে সূচনা হলো এক নবতর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। আরবের মরু প্রান্তর থেকে শুরু হলো ইসলামি সংস্কৃতির এই অভিযাত্রা। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিপ্লবী চিন্তাধারা আর সাহাবাগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও তাদের অব্যাহত সংগ্রামের ফলে ধীরে ধীরে বিশ্বে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। আর ইসলামি সংস্কৃতির কাছে জাহিলিয়্যাতের সকল অপসংস্কৃতি পদানত হয়। সাথে সাথে ইসলামি সংস্কৃতিরও বিজয় সূচিত হয়। ফলশ্রুতিতে সমগ্র বিশ্বব্যাপি ইসলামি সভ্যতারও বিজয় ঘটে।
মনে রাখতে হবে, সভ্যতা ও সংস্কৃতি হলো ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমনকি ধর্মের সাথে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক হলো আত্মার সম্পর্ক। একটি সভ্যতার জয় পরাজয় নির্ভর করে তার সংস্কৃতির জয় পরাজয়ের ওপর। আর এই কারণেই আমরা দেখতে পাই ইউরোপীয়রা তাদের রেনেসাঁ যুগে প্রথমেই নতুন করে সাংস্কৃতিক বিপ্বলের সুত্রপাত ঘটায়। এমন কি তা পরবর্তীতে আগ্রসন রূপ পরিগ্রহ করে। অর্থাৎ তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সূচনা করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আদৌ পর্যন্ত পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে এই নগ্ন আগ্রাসন পরিচালিত হয়ে আসছে।
চলমান শতাব্দীতে সমগ্র বিশ্বে নতুন করে বিভিন্ন সভ্যতার মাঝে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অসম প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর সবগুলোই মূলত পরিচালিত হচ্ছে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই। ভারতীয়রা বাংলাদেশে, চীন ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় এবং পাশ্চাত্যরা আরববিশ্বসহ সমগ্র ইসলামি বিশ্বে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালিত করছে। আর এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ভিন্ন সভ্যতার ওপর প্রাধান্য বিস্তার কারা।
পাশ্চাত্যরা ঔপনিবেশিক শাসনের সুযোগে বিশ্বের সর্বত্রই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালিত করে। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে চলা তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রবল স্রোতের মোকাবেলায় একমাত্র জাপানী সভ্যতা ব্যতিত বাকি সকল সভ্যতাই তাদের নিকট অসহায় আত্মসমর্পণ করে। ফলশ্রুতিতে অন্যান্য সকল সভ্যতাই পাশ্চাত্য সভ্যতার নিকট ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে যায় এবং ওগুলোর পরাজয় ঘটে। ইসলামি সভ্যতার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
উল্টো বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে ভারত ও চীন পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি তিন দিক থেকেই আগ্রাসনের শিকার হয়। এতে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনেকটাই সঙ্কুচিত, ম্রিয়মাণ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি যেন আরো প্রবল রূপ পরিগ্র হ করে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের হীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে পরাজয়ের বৃত্তে আবদ্ধ।
এহেন পরিস্থিতে ইসলামি উম্মাহ্র করণীয় হলো নতুন করে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এর ওপর একটি বিপ্লবের সুত্রপাত করা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা সমগ্র ইসলামি বিশ্বে রাজনৈতিক ইসলামের যে উত্থান প্রত্যক্ষ করছি, সমগ্র বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান আমরা লক্ষ করছি, ভবিষ্যতে ইসলামি সভ্যতার শক্তিশালী অবস্থানের যে সম্ভাবনা আমাদের পরিদৃষ্টি হচ্ছে এই পরিস্থিতে যদি নতুন করে বিশ্বব্যাপি ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো যায় তাহলে অবশ্যই আগামীতে ইসলামি সভ্যতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আমার কাছে অনুমিত হয় এবং বোধ করি এর মাধ্যমে অন্যান্য সকল সভ্যতার ওপর ইসলামি সভ্যতা প্রভাব বিস্তার করে নিতে সক্ষম হবে বৈকি।
তবে আশার আলো যে, ইতোমধ্যে তুরস্ক ও কাতার রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের কাজ সূচনা করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াসহ কতিপয় মুসলিমরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয়ভাবে না হলেও কতিপয় ইসলামিস্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা নিজেরা ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পহমফ মোতাবেক কাজ করে যাচ্ছে।
মোদ্দাকথা হলো, চলমান শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহর বড় দায়ীত্ব ও করণীয় হলো পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও চৈনিকদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা করে ইসলামি সংস্কৃতির সুন্দর বিকাশ ঘটানো। এতে অবশ্যই ইসলামি সভ্যতা সমগ্র বিশ্বে এক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হবে বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আর এর মাধ্যমেই আগামীতে ইসলামি সভ্যতার জন্য বিশ্ব নেতৃত্বের পথ সুগম হবে ইনশাআল্লাহ।
বিশ্বমিডিয়ায় শক্তিশালী
অবস্থান তৈরি করা
বর্তমানে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম মিডিয়া। পশ্চিমারা মিডিয়ার কল্যাণেই পুরো বিশ্বকে বিশেষ করে ইসলামি বিশ্বকে তাদের করায়ত্তে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ইহুদি জায়নবাদীরা বিশ্বকে শাসন করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, সেখানে মিডিয়াকেই তারা তাদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। থিওডোর হার্জলের নেতৃত্বে জায়নবাদী ইহুদিরা ১৮৯৭ সালে The protocols of the Elders of Zion নামে যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল সেখানেও ইহুদিদের কর্তৃক বিশ্ব মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। তাদের সেই পরিকল্পনা মোতাবেকেই ইহুদিরা আজ বিশ্ব মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে বড় বড় সমস্ত মিডিয়া কোম্পানীর প্রধান হলো ইহুদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ৯৬ শতাংশ মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণকর্তা হলো মাত্র সাতটি ইহুদি কোম্পানি। মুসলমানদের প্রধান শত্রু যে ইহুদি জাতিগোষ্ঠী এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এই ইহুদিরা বিশ্বের প্রায় তাবৎ মিডিয়া কোম্পানির মালিক হওয়ার সুবাদে পুরো বিশ্বমিডিয়া কাজ করছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে। বলতে গেলে পশ্চিমারা মিডিয়াকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আর বর্তমানে যুদ্ধের ময়দানে মিডিয়াই যে প্রধান অস্ত্র, বোধকরি এ কথাটি কম বেশি সকল সচেতন নাগরিক ও শিক্ষিতজনেরা ভাল করেই জানেন। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পশ্চিমারা এই দুটি যুদ্ধে যতটাই-না জয় লাভ করেছে তার চেয়েও আরো বেশি হাক-ডাক ছেড়ে বেশ জোড়ে-শোরেই প্রচার করেছিল তাদের জয়ধ্বনি নিয়ে। ইরাকি জনগণ আর তালেবানদের কিছুটা সাফল্য থাকলেও সেগুলোকে ম্রিয়মাণ প্রতীয়মান করে তাদের পরাজয়টাকেই বেশি হাইলাইট করে প্রচার করে তারা। আর এই মিডিয়াই প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আগেই অনেকটা তাদের জয়-পরাজয়কে নির্ধারণ করে ফেলে। অর্থাৎ শত্রপক্ষের বিরুদ্ধে মিডিয়ার অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণার ফলে যুদ্ধের আগেই প্রতিপক্ষের মনোবলে চিড় ধরে যায়। ফলে যুদ্ধের আগেই তারা অনেকটা হেরে বসে।
পশ্চিমা বিশ্বে আজ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে এতে প্রধানত পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াই দায়ী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের সমস্ত মিডিয়াগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে নেতিবাচক প্রচারণার ফলেই খ্রিষ্টানজগতে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে এক বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্য জগতে ব্যাপকভাবে ইসলাম ফোবিয়া ও মুসলিম বর্ণবাদের সৃষ্টি হয়েছে।
এর ওপর একটি গবেষণা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, অ্যান্টি ইসলামিক সেন্টিমেন্ট অ্যান্ড মিডিয়া ফ্রেমিং, জার্নাল অব রিলজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটির ২০১৩ ইস্যুতে। এখানে পিউ ফোরাম অন রিলিজিয়ন অ্যান্ড পাবলিক লাইফ সার্ভে, এবিসি নিউজ পোলসহ বহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
পিউ সার্ভেতে দেখা যায়, ২০০১ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণের পরও আমেরিকায় মুসলিম বিরোধী মনোভাব কম ছিল। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণায় জনগণের মনোভাবে অনেকটা পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করে। পিউ এক সার্ভেতে জানিয়েছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যদের এই মনোভাব ২০০২ থেকে শুরু হয় এবং তা এখন বেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন। ২০১২-১৪ সালের সার্ভেতে দেখা যায় প্রায় শতাংশ মার্কিনিরা মুসলমান ও ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে আসছে। যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন তারা এমনটি ভাবে, তারা জবাব দেয় সংবাদপত্রের রিপোর্ট এবং সোস্যাল মিডিয়ার আলোচনাই তাদের এই মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করে। তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ বলে, এ ব্যাপারে তাদের ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর মাত্র ৫ শতাংশ যারা ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানদের চেনে বা তাদের প্রতিবেশি, তারা এমনটি ভাবেন না। বরং তারা মুসলমানদের প্রশংসা করে।
পিউ ফোরামের এই বিশ্লেষণের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার একমাত্র কারণ হলো, বিশ্ব মিডিয়ায় পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিশ্ব মিডিয়ার বাজার একচেটিয়াভাবে পশ্চিমাদের বিশেষ করে ইহুদিদের দখলে থাকার কারণেই আজ মুসলমানরা প্রপাগান্ডার শিকার হচ্ছে। আর পশ্চিমা মিডিয়ার তল্পিবাহক হিসেবে মুসলমানদের মিডিয়াগুলোও ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার আশ্রয় নিচ্ছে। সুতরাং ইসলাম ও মুসলমানরা আজ দুইদিক থেকেই আক্রমণের শিকার। এই অমোঘ পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের করণীয় হলো বিশ্ব মিডিয়ায় তাদের অবস্থানকে জোড়দার ও সুসংহত করা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাদেরকে দৃঢ় ও মজবুত অস্থানে নিয়ে যাওয়া।
বর্তমান যুগটা যে মিডিয়া ও প্রযুক্তির যুগ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মিডিয়া ও প্রযুক্তির যুগে মুসলিম বিশ্বের মিডিয়া থেকে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইসলামি বিশ্ব অবশ্যই যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বরাবরই ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। মুসলিম বিশ্ব যদি বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমাদের মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারত তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলামি বিশ্ব পশ্চিমাদের এই মিডিয়া আগ্রাসনের সমূচিত জবাব দিতে সক্ষম হতো। আর মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমাদের একতরফাভাবে মিডিয়া আগ্রাসনের শিকার হয়ে এতোটা বিপর্যয় ও পর্যদুস্ত হতো না।
পশ্চিমারা আজ বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে যেভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এর মোকাবিলায় মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে ইসলামিস্টরা ইসলাম যে একটি সন্ত্রাসী ধর্ম নয় বরং ইসলাম মানবতা ও মানবিকতার ধর্ম, ইসলাম শান্তির ধর্ম এই সত্য কথাটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে পশ্চিমাদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। ইসলামের সঠিক রূপরেখা ও তার সৌন্দর্যকে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার করে সবার নিকট তুলে ধরতে আমরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। তার মূল কারণই হলো বিশ্ব মিডিয়ায় আমাদের দূর্বল অবস্থান। আলজাজিরা কিছুটা হলেও অনেক প্রতিকূলতার মাঝে মুসলিমদের পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছে। তবে পশ্চিমাদের মোকাবিলায় শুধু এই একটি চ্যানেল অপ্রতুল ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইসলামের নির্দেশ হলো, অমুসলিমরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ধরণের অস্ত্র প্রয়োগ করে, মুসলমানরাও সে ধরণের অস্ত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ ؕ ۰۰۶۰
‘শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধোপকরণ তৈরি করে নাও যতটা তোমাদের পক্ষে সম্ভব।’ (সূরা আল-আনফাল: ৬০)
আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পশ্চিমারা মিডিয়াকে বর্তমানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আমার এই কথাটির সাথে কেহ দ্বিমত পোষণ করলেও যদি তিনি পশ্চিমা মিডিয়ার অবস্থানকে একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন তাহলে আশা করি তিনিও মিডিয়াকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের একটি যুদ্ধাস্ত্র বলে স্বীকার করে নিবেন। আর যদি তাই হয় তাহলে উক্ত আয়াতের আলোকে একথা বলতে মোটেও দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে মিডিয়ায় জোড়ালো ও স্বক্রীয়ভাবে অংশ গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য ফরজ।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে মিডিয়া অন্যতম প্রচার যন্ত্র। মিডিয়া বিহীন বিশ্ব বিকল। প্রতিটি মানুষ এখন মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। বিশ্বের প্রতিটি খবরই মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুতই মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছে। সুতরাং ইসলামের সঠিক রূপরেখা তার সুন্দর আদর্শ ও অনুপম গুণাবলি মিডিয়ার মাধ্যমে সহজেই মুসলিম-অমুসলিম সবার নিকট পৌছে দেওয়া সম্ভব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُ١ؕ ۰۰۱۲۵
‘তোমার পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।’ (সূরা আন-নাহল: ১২৫)
কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে হিকমতের বহু অর্থ বর্ণনা করা হলেও বর্তমানর যুগ হিসেবে মিডিয়াকেও যদি আমরা হিকমতের অর্ন্তভুক্তি করে নেই, বোধ করি এটা বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আয়াতের ভাবার্থের সাথে যথাযথ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। বর্তমান যুগ অনুযায়ী এটা মোটেও আয়াতের অপব্যাখ্যা হবে না। আমার দৃষ্টিতে বর্তমান যুগে এটা আয়াতের অন্যতম একটি ব্যাখ্যার দাবী রাখে। কারণ উক্ত আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দাওয়াতের প্রতি নির্দেশ প্রদান করতঃ তার পদ্ধতিও বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। আর মিডিয়া যে বর্তমানে অন্যতম একটি প্রচার মাধ্যম ও পদ্ধতি এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং এই যুগে মুসলিমদের বিশ্ব মিডিয়ায় তার স্বক্রীয় অবস্থানের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলো ¯^µxq ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে তারা মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। আমার ধারণামতে বর্তমানে এটাই হবে উম্মাহর বড় খেদমত। এতে তা পশ্চিমাদের মোকাবিলা করা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার অন্যতম ব্যবস্থা বলেই পরিগণিত হবে। তবে আশার বাণী হলো, বর্তমানে আরবে মিডল ইস্ট, আল-আরাবিয়া ও আল জাজিরার মতো কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া চ্যানেলের অভ্যূদয় ঘটেছে। ওগুলোর মধ্যে আল-জাজিরাই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মিডিয়া এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে পাশ্চাত্যরা চ্যানেলটি বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে। আরবদের কাজ হলো, পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রে পা না দিয়ে চ্যানেলটি রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা। সুতরাং আল-জাজিরার ন্যায় যদি আরো কয়েকটি শক্তিশালী চ্যানেল তৈরি করা যায় তাহলে অবশ্যই অনেকটা সহজভাবে পশ্চিমাদের মোকাবিলা করা সম্ভব। আশা করি ইসলামি বিশ্ব অতিদ্রুত এই পদক্ষেপটা গ্রহণ করবে।
অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করা
বর্তমানে ইসলামি বিশ্বের রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী ও ভূ-গর্ভস্থ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু অতি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে মুসলিমরা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পাশ্চত্যের তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে। ইসলামি বিশ্বের দু-চারটি রাষ্ট্র ছাড়া বাদবাকি সকল রাষ্ট্রের জনগণই বাস করে দারিদ্র সীমার নিচে। তাদের জীবন যাত্রার মানও অনেক অনুন্নত। বহু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থাও যথেষ্ট শোচনীয়। যার ফলে অর্থনৈতিক সূচকে ইসলামি বিশ্ব পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় রয়েছে অনেক অনেক পিছিয়ে। অথচ মুসলিম জনশক্তি পশ্চিমা জনশক্তি থেকে মোটেও কম নয়। প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল মজুদও রয়েছে তাদের হাতেই। বিশ্বের পেট্রোডলারের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের ৫৫ শতাংশই আছে ইসলামি বিশ্বের হাতে। কিন্তু বিশাল এই জনশক্তিকে টেকনিক্যাল ও প্রযুক্তিতে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে না তোলার কারণে এবং বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে সদ্বব্যহারের অভাবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এবং টেকনিক্যাল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দ্বারস্থ হচ্ছি পশ্চিমাদেরই নিকট। মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্বের রাজনীতি ও সমরনীতির মূল নিয়ন্ত্রণকর্তা হলো অর্থনৈতিক শক্তি। যে যত বেশি অর্থনৈতিকভাবে ¯^wbf©i ও আত্মনির্ভরশীল হবে সে বিশ্বের রাজনীতি ও সমরনীতি নিয়ন্ত্রণে ততটাই ফ্যাক্টর ও শক্তিশালী হবে।
এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি চীন বৈশ্বিক রাজনীতি ও সমরনীতিতে অন্যতম প্রধান খেলোয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। উঃ কোরিয়া, মিয়ানমার ও জিম্বাবুয়ের রাজনীতির চাবিও তারই হাতে। বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকর্তাও এই চীন। বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীনের এই গুরুত্বের মূল কারণই হলো তার বিপুল অর্থনৈতিক শক্তি। আর চীন তার এই বিপুল অর্থনৈতিক শক্তিকে অর্জন করেছে তার বিশাল জনশক্তিকে টেকনিক্যাল ও প্রযুক্তিতে অসামান্য দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার সুবাদেই এবং অঢেল সম্পদের সদ্বব্যবহারের কারণেই। ফলশ্রুতিতে সে হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিশালী রাষ্ট্র। অধুনা চীন অর্থনীতি ও সমরনীতিতে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আর পশ্চিমাদের নেই।
কিন্তু ইসলামি বিশ্ব তার বিপুল জনশক্তিকে প্রযুক্তিতে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে না তোলার কারণে এবং তার অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদকে যথাযথ ব্যবহার না করার কারণে বৈশ্বিক রাজনীতিতে শুধু সে পিছিয়েই নেই বরং পশ্চিমাদের হাতের পুতুল হয়ে তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু ইরান আর তুরস্ক। এই দুটি রাষ্ট্র যুগের ভাষা ও চাহিদা বুঝতে পেরে চলমান শতাব্দীতে প্রযুক্তিতে কিছুটা হলেও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে তারা বৈশ্বিক রাজনীতিতে না হলেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে দিন দিন তুরস্কের বৈশ্বিক রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে উঠার মতো আলামত প্রতিভাত হচ্ছে। ইসলামি বিশ্ব চলমান শতাব্দীতে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি অর্জনের জন্য শুধু আঞ্চলিক শক্তি নয় বরং বৈশ্বিক শক্তিও অর্জন করতে হবে। তাহলেই বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে তারা আবির্ভূত হতে পারবে এবং বিশ্ব নেতৃত্বও পুনরায় তাদের নিকট ফিরে আসার পথ তৈরি হবে। সর্বোপরি ইসলামি বিশ্বের নিরাপত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
এর জন্য প্রয়োজন হলো, তাদের জনশক্তিকে প্রযুক্তিগত অঙ্গনে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা আর তাদের ভূ-গর্ভস্থ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে জাতীয়করণ করে ওগুলোর সদ্বব্যবহার করা। ইসলামি বিশ্বের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করে ওগুলোকে মজবুত ও দৃঢ় করা। সেক্ষেত্রে ওআইসি এবং সিওএমসিইসি আরো কার্যকর উদ্যোগ ও ভূমিকা নিতে হবে। তাহলেই আশা রাখি ইসলামিবিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে স্বনির্ভর ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে অগ্রসর হতে পারবে। এর ফলে ইসলামি বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
মুসলিম বিশ্বে ঐক্য জোরদার করা
ইসলামিবিশ্ব জুড়ে আজ যে সঙ্কট বিরাজমান এর জন্য মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যই যে দায়ী একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক বিবাদ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতার মোহে অন্ধভাবে পশ্চিমাদের শরণাপন্ন হওয়া ইত্যাদি কারণে ইসলামি বিশ্ব আজ শতধাবিভক্ত। তাদের পারস্পরিক এই অনৈক্য ও বিভক্তির সুযোগে পশ্চিমারা ইসলামিবিশ্ব থেকে তাদের ষোলকলা পূর্ণ করছে। মুসলিম বিশ্বের একদল শাসকদের চোখের সামনেই অন্য শাসককে ধ্বংস করে পশ্চিমারা মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে এক দুর্বিষহ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে মুসলমানদের পেট্রোডলারের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদকে। মুসলিম শাসকদের চোখের সামনেই স্বজাতির মা-বোন ও ভাইদের পাখির মতো নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করছে কিন্তু উচ্চ কন্ঠে না হলেও মৃদু ভাষায়ও প্রতিবাদ করবে সে সাহসটুকুও তারা পাচ্ছে না। এর মূল কারণ হলো মুসলিম বিশ্বের মাঝে বিভক্তি ও তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং তাদের অনৈক্য।
আজ মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে সত্যিই বড় লজ্জা অনুভূত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে তারা যেমনিভাবে অনৈক্যের মাঝে লিপ্ত আছে ঠিক তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও তারা রয়েছে চরম বিভক্তির মাঝে। আর্ন্তজাতিকভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে শুধু নিজের বা দলের হীন স্বার্থকে চারিতার্থ করার নিমিত্তে পুরো উম্মাহর স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে সম্পর্ক করে স্থাপন করে যাচ্ছে পশ্চিমাদের সাথে বা অন্য কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথে। একটি মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চিত্রও একই রকম। শুধু এক শ্রেণির বিপথগামী রাষ্ট্রনায়কদের খামখেয়ালীপনা, স্বেচ্ছারিতা ও স্বৈরাচারিতার কারণে তার মাসুল গুণছে পুরো উম্মাহ। ক্ষমতার মোহ তাদেরকে এতটাই অন্ধ করে রেখেছে যে, তারা একটিবারের জন্যও তাদের এহেন কৃতকর্ম নিয়ে ভাবার ফুরসতটুকুও পায় না। তারা একটিবারের জন্যও একটু অনুশোচনায়ও দগ্ধ হয় না এই ভেবে যে, আমি উম্মাহর এতটা ক্ষতি কেন করছি?
একথা মোটেও অসত্য নয় যে, গুটি কয়েক শাসকদের স্বেচ্ছারিতা আর স্বৈরাচারিতার কারণেই আজ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক ভূতড়ে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যের কারণেই ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আরাকান, মিন্দানাও ও চেচনিয়ার সমস্যা সমাধান আজো হয়নি। ইরাকে হামলার আগে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আরব মুসলিম শাসকরা এই হুংকারটাও ছাড়তে পারেনি যে, আমাদের আরবদের সমস্যা আমরাই সমাধান করবো, আমাদের ইসলামি বিশ্বে পশ্চিমাদের হামলার কোনো অধিকার নেই। হামলা হলে আমরাও সম্মিলিতভাবে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাব। যেমনিভাবে এমন একটি কঠিন বাণী উচ্চারণ করেছিলেন হযরত মুআবিয়া (রাযি.)। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে যখন রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে হযরত আলি (রাযি.) ও হযরত মুআবিয়া (রাযি.) এর মাঝে বিরোধ তুঙ্গে তখন তৎকালীন পরাশক্তি রোমের শাসক এই কথা ভাবলেন যে, মুসলমানদের এই দ্বন্দ্বের সুযোগে বোধকরি মুসলিমভূখন্ডে আক্রমণ চালিয়ে ইসলামকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হবে। এ রকম একটি পরিকল্পনা নিয়ে যখন রোম সম্রাট ইসলামি সিমান্তে সৈন্য সমাবেশ করলেন তখন হযরত মোআবিয়া (রাযি.) বজ্রহুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, যদি রোম সম্রাট আর একটি কদম ইসলামি বিশ্বের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয় তাহলে আমিই সর্বপ্রথম রোমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো। মুআবিয়া (রাযি.) এর এই বজ্র হুংকারে রোম সম্রাট ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তখন পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই আদর্শের অধিকারী মুসলিম শাসকদের আজ বড়ই অভাব। মুসলিম উম্মাহর সোনালী যুগে তাদের এই আদর্শের কারণেই গোটা বিশ্বকে তারা শাসন করেছিলেন অসীম সাহস ও হিম্মত নিয়ে। সেই একই আদর্শ আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে। আর এক সময়ে ইহুদি খ্রিষ্টানদের মাঝে থাকা অনৈক্য আজ চলে এসছে মুসলিম উম্মাহর মাঝে। পশ্চিমারা যেখানে ইসলামি বিশ্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সেক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ক্ষেত্রে বরাবরই বিভক্ত ও অনৈক্য। এই একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহ যদি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চায় এবং ইসলামি বিশ্বের চলমান সঙ্কটকে নিরসন ও ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে চায় তাহলে অবশ্যই মুসলিম বিশ্ব তাদের সকল ভেদাভেদ ও মতপাথর্ক্যকে ভুলে গিয়ে তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে জোড়দার করতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান থাকা শিয়া, সুন্নি, ওহাবী ও দেওবন্দী দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতই তাদেরকে পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করে তাদেরকে ধ্বংসের অতলগহ্বরে নিপতিত করে দিয়েছে। তারা নিজেরাই আজ নিজেদের নিকৃষ্টতম শত্রুতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমাদের কায়েমী স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য সুন্নি আরবরাও নিজেদেরকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চলতি বছর সৌদি-কাতার দ্বন্দ্বই তার বাস্তব রূপ। এ ধরনের দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি পশ্চিমাদেরই নয় বরং আমাদেরই ক্ষতির কারণ হবে। আমাদেরই ধ্বংস বয়ে আনবে বৈকি। যার পরিপূর্ণ সুযোগ ও ফায়দা লুফে নিচ্ছে পাশ্চত্যরা।
paul caraig Roberts ইনফরমেশন ক্লিয়ারিং হাউসে প্রকাশিত তার এক লেখায় অতি স্পষ্টভাবে এই সত্য কথাটি তুলে ধরে তিনি বলেন, Muslims are their own worst enemy অর্থাৎ মুসলমানরাই হচ্ছে মুসলমানদের নিকৃষ্টতম শত্রু।
তিনি আরো বলেন, পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলমান, কিন্তু এরা শক্তিহীন। মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন, বিশেষ করে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভাজন মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যকে শতাব্দী যাবৎ ঠেলে দিয়েছে পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে। মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি এতটাই প্রবল যে, এরা একসাথে খেলতে পর্যন্ত পারে না। অলিম্পিকের আঞ্চলিক সংস্করণ দ্য ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ইরানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এপ্রিলে। তাও বাতিল করা হয়েছে। কারণ ইরানি ও আরবরা একমত হতে পারে না কী নামে ডাকবে ইরান ও আরব উপদ্বীপকে বিভক্তকারী জলস্থলকে, পারস্য উপসাগর না আরব্য উপসাগর?
পল ক্রেগ রবার্টেস এর মন্তব্য মোটেও অত্যুক্তি নয়। এ ধরণের অনৈক্য আর বিভাজনই নিঃশেষ করে দিচ্ছে ইসলামি বিশ্বকে। মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যই যে মুসলমানদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ তা আল্লাহ তাআলা কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍ١ؕ اِلَّا تَفْعَلُوْهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْاَرْضِ وَ فَسَادٌ كَبِيْرٌؕ۰۰۷۳
‘আর যারা কাফের তারা পরস্পর পরস্পরের সহযোগী ও বন্ধু। আর তোমরা যদি এই পন্থা অবলম্বন না কর তাহলে বিশ্বব্যাপি দাঙ্গা-হাঙ্গামার সুত্রপাত হবে এবং পৃথিবী জুড়ে দেখা দিবে বড়ই দন্দ্ব ও সঙ্ঘাত। (সূরা আল-আনফাল: ৭৩)
আজ ইসলামিবিশ্ব জুড়ে আল্লাহ তাআলার এই বাণীর বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইসলামিবিশ্বে বিরাজমান এই দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতকে নির্মূল করতে হলে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের করণীয় হলো, আর্ন্তজাতিকভাবে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে জোড়দারভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে উম্মাহর বৃহত্তম স্বার্থে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতবিরোধকে বিসর্জন দিতে হবে। তাদের মনে এই বাসনা লালন করতে হবে যে, আমরা মুসলমান। আর এই ইসলাম ও মুসলমানিত্বের ভিত্তিই তাদের মাঝে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এর মাঝেই তাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا۪ ۰۰۱۰۳
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
এই আয়াতের মাঝে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন। আয়াতের মাঝে আল্লাহ তাআলা এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তি হলো, আল্লাহর রজ্জু তথা দীনে ইসলাম। অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহ ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতেই তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তাদের পরিচয় থাকবে তারা মুসলমান। শত্রুর মোকাবিলায় সকল মুসলমান এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তাহলেই মুসলমানরা অমুসলিমদের কর্তৃক কোনো ক্ষতি এবং ধ্বংসের মুখোমুখি হবে না।
কিন্তু আজ উম্মাহ আল্লাহর এই চিরন্তণ বাণী থেকে অকেটাই দূরে সরে গেছে। যার কারণেই উম্মাহ আজ এতটা বিপর্যস্ত ও ভঙ্গুর জাতিতে পরিণত হয়েছে। যদি মুসলমানরা ইসলামিবিশ্বে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা মুসলিম বিশ্বের সঙ্কটকে দূরীভূত করে সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় তাহলে তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাই অবশ্যই তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জোড় চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নিন্মোক্ত প্রক্রিয়াগুলো অবলম্বন করলে আমি আশাবাদী মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইস্পাত কঠিন ঐক্য তৈরি হবে।
(১) মুসলিম জাতীয়তাবোধ প্রতিষ্ঠা:
ইসলামি বিশ্বে মুসলিম জাতিয়তাবোধ বলতে আজ কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে পাশ্চাত্যের নগ্ন জাতীয়তাবাদ। যে জাতীয়তাবাদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আজ গোটা মুসলিম বিশ্ব পরিণত হয়েছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন জাতিতে। আজ মুসলিম বিশ্বে যে বিভক্তি ও অনৈক্য বিরাজমান, তাদের পরস্পরের মাঝে যে কোন্দল ও দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর মূল কারণই হলো পশ্চিমা জাতিয়তাবাদ। আজ উম্মাহর চোখের সামনেই নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে মুসলিম নারী ও শিশুরা। অমুসলিমদের নিষ্ঠুর ও নির্মম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে লাখো মুসলিম বনি আদম। কিন্তু আঞ্চলিকতার ব্যবধান, গোত্র ও ভাষার তারতম্যের অজুহাতে আজ একদল উম্মাহ অন্য উম্মাহর সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে না। বরং নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে উম্মাহকে আরো ধ্বংসের দিকে নিপতিত করে তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ধরনের আদর্শ ও বৈশিষ্ট ভিন্ন কোনো সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর হতে পারে কিন্তু মুসলিম উম্মাহ এ ধরনের হীন আদর্শ প্রদর্শন করতে পারে না। উম্মাহর আদর্শ হলো, তারা একই সত্তার অধিকারী। তাদের রক্ত ও গোশত এক। তাদের মাঝে আঞ্চলিকতা, গোত্র, বর্ণ ও ভাষার কোনো ব্যবধান থাকতে পারে না। তারা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত থাকতে পারে না। পুরো পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম উম্মাহ তারা এক ও অভিন্ন জাতি। সবার মাঝে প্রতিষ্ঠা থাকবে হৃদ্যতা আর ভালবাসার সেতু বন্ধন। পারস্পরিক আন্তরিকতা আর সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে তারা। তাদের সবার সুখেই সুখী হবে তারা। আর একটি অঞ্চল ও গোত্র নয় রবং একজন মুসলিমের দুঃখেই গোটা উম্মাহই দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে। একজনের কষ্টেই আহত ও ব্যথিত হবে পুরো উম্মাহ।
এটাই হলো মুসলিম জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ। কিন্তু অতি দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আমাদের বলতে হচ্ছে, এই আদর্শ ও বৈশিষ্ট থেকে উম্মাহ আজ দূর থেকে বহুদূরে। ওই আদর্শের সিকিয়ানাও আজ উম্মাহর মাঝে অবশিষ্ট নেই। আমাদের মাঝে জেঁকে বসেছে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের অভিশাপ। যা উম্মাহকে আজ কুড়ে কুড়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ উম্মাহকে আজ শতধাবিভক্তির মাঝে নিপতিত করে রেখেছে এই হীন জাতীয়তাবাদ ইসলাম কখনোও সমর্থন করে না। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
«الْـمُسْلِمُ أَخُ الْـمُسْلِمِ.«
অর্থাৎ একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللّٰهِ١ؕ وَالَّذِيْنَ مَعَهٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ ٞ ۰۰۲۹
‘মুহাম্মদ (সা.) যিনি হলেন আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচরবৃন্দ তাদের বৈশিষ্ট ও আদর্শ হলো, তারা কাফেরদের প্রতি হবে অত্যন্ত কঠোর আর তাদের পরস্পর পরস্পরের প্রতি হবে প্রকট সহানুভূতিশলী ও আন্তরিক।’ (সূরা আল-ফাতাহ: ২৯)
উল্লেখিত হাদীস ও আয়াত দুটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে মুসলিম জাতীয়তাবোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি নির্দেশ প্রদান করে। আজ উম্মাহর মাঝে মুসলিম জাতীয়তাবোধের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। আজ উম্মাহর মাঝে যে বিভক্তি ও বিভাজন পরিলক্ষিত হচ্ছে এর মূল কারণই হলো আমাদের মাঝে মুসলিম জাতীয়তাবোধের এই ধারণা বিদ্যমান না থাকা।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মাঝে যতদিন যাবৎ এই আদর্শ ও বৈশিষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত তাদের মাঝে ঐক্য সুসংহত ছিল এবং তারা ছিল নেতৃত্বের ময়দানে। তাদের থেকে সেই আদর্শের বিচ্যুতির কারণেই আজ তারা পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইসলামি সভ্যতার অনন্য নিদর্শনসমূহ। সুতরাং আজ যদি উম্মাহ আবার তাদের মাঝে ঐক্য ও একতা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে অবশ্যই পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ পরিহার করে মুসলিম জাতীয়তাবাবোধের ধারণা তাদের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই বোধ করি তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে এবং তারা মুক্তি লাভ করবে পাশ্চাত্যের অব্যাহত নিপীড়ন থেকে। আর এই ধরনের ঐক্যই মুসলিমদের নিয়ে যাবে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে।
জোট সংগঠনগুলো শক্তিশালী করা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পূর্ব-পশ্চিমে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য উভয়ই জোটবদ্ধ হয়ে শক্তি অর্জনের পথ Aej¤^b করে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব পুরোপুরি সফল হলেও ইসলামি বিশ্ব তার ছিটে-ফোটাও অর্জন করতে পারেনি। অথচ মুসলিম বিশ্বের রয়েছে দু দুটি শক্তিশালী সংগঠন আরবলীগ ও ওআইসি। তন্মধ্য হতে ওআইসি হলো জাতিসঙ্ঘের পরেই সবচাইতে বড় সংগঠন। সাতান্নটি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যতম বৃহৎ এই সংগঠনটি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো আরবলীগ ও ওআইসী সংগঠন দুটি মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ রক্ষায় বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ রক্ষায় সংগঠন দুটি কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারেনি। অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এ কথাও বলেন যে, সংগঠন দুটি পশ্চিমাদের ক্রীড়নক হয়েই কাজ করছে। এ কথাটি আমার কাছে মোটেও অত্যুক্তি নয়। কারণ, ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও আরাকানের সমস্যা নিরসনে আদৌ কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি এই দুটি সংস্থা। যদি এই দুটি সংস্থা আন্তরিকতার সাথে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত তাহলে অনেক আগেই মুসলিম বিশ্বের এই সঙ্কটসমূহের সমাধান হয়ে যেত।
অতিসম্প্রতি ওআইসির দুটি ভূমিকা কিছুটা হলেও ইসলামি বিশ্বকে আশান্বিত করছে। ২০১৬ এর ১৯ শে জানুয়ারী মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে ওআইসির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ১০ দফার ইশতেহার ঘোষণা করে ওআইসি। এক্ষেত্রে অবশ্যই মালয়েশিয়ার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সর্বশেষ ২০১৭ এর ডিসেম্বরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হয় ওআাইসির শীর্ষ সম্মেলন। সেখান থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আমি আশান্বিত এই জন্যই যে, অনেক দেরীতে হলেও ওআইসির ঘুম ভেঙ্গেছে। বোধ করি ওআাইসির ওই বৈঠক দুটি অমুসলিম বিশ্বকে কিছুটা হলেও বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আশাহত ও বেদনাহত উম্মাহর মাঝে আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছে।
সুতরাং এই আরব লীগ ও ওআইসী সংগঠন দুটিকে প্রয়োজনে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে এবং এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে আরো সুদৃঢ় করে তাকে জোড়দার ও মজবুত করতে হবে। এতে শুধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্কটেরই সমাধান হবে না বরং বিশ্ব নেতৃত্বের আসন পুনর্দখল করাও সম্ভব হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলো, মুসলিম বিশ্বের শাসকগণ পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামি বিশ্বের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো মনোভাব প্রদর্শন করা। তাহলেই সংগঠন দুটিকে মজবুত ও দৃঢ় করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে উম্মাহর মাঝে ঐক্য সু-সংহত ও শক্তিশালী হবে বৈকি।
(৩) মুসলিম জাতিসঙ্ঘ গঠন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুরো বিশ্বের স্বার্থের কথা বলা হলেও মূলত পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ। জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই তা পশ্চিমা বিশ্বের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে। মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ তার নিকট বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে অধুনা অনেক মুসলিম বিজ্ঞজনদের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসঙ্ঘ গঠনের জোড়ালো প্রস্তাব উত্থাপিত হচ্ছে। বর্তমানে ইসলামি বিশ্বের প্রতি পশ্চিমাদের দ্বি-মুখী নীতির কারণে পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত একটি স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসঙ্ঘ গঠন সময়ের বড় দাবী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এর মাধ্যমেই ইসলামি বিশ্বের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট সমাধানও সম্ভব। সুতরাং মুসলিম শাসকদের চলমান শতাব্দীতে তাদের বড় কাজ হলো একটি মুসলিম জাতিসঙ্ঘ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক, মালয়েশিয়া অথবা সৌদি আরব কোর রাষ্ট্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার সুবাদে পাকিস্তানও এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। আশাকরি এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য সুদৃঢ় ও সু-সংহত হবে। মুসলিম বিশ্ব নিজেরাই নিজেদের সঙ্কট দূর করতে পারবে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের ঔদ্ধত্য আচরণ থেকে ইসলামি বিশ্ব অবশ্যই নিরাপদ থাকবে।
ন্যাটোর আদলে সামরিক জোট গঠন
মুসলিম বিশ্বের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও বর্হিবিশ্বের আক্রমণ থেকে ইসলামি বিশ্বকে নিরাপদ রাখার এটাও একটা প্রক্রিয়া হতে পারে যে, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে ন্যাটোর আদলে একটি সামরিক জোট গঠন করা। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন হয়েছিল। এই জোটে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও আলজেরিয়া নেই। তাছাড়া এই জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাস দমন করা। তাই এই জোট গঠন নিয়ে অনেক মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ সন্দেহ পোষণ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এই জোট হলো আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোরই সহযোগী একটি জোট। অনেকে বলেছেন, আমেরিকার পরোক্ষ ইন্ধনে সৌদি আরব আকস্মিক এই জোট গঠন করেছে। অর্থাৎ এই জোট গঠনের আগে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। অনেক এমনও রাষ্ট্র আছে যেগুলো যে ওই জোটের সদস্য তা সে জানতে পেরেছে তার নাম ঘোষণার পরেই। অর্থাৎ শুরুতেই এই জোটের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয়। ফলেই অনেক মুসলিম রাষ্ট্রই এই জোটের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া ছিল এর মধ্যে অন্যতম। যদিও দেশ দুটি পরে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে পুনরায় জোটের অর্ন্তভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এখনোও এই জোট প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে মুক্ত নয়।
শুধু সন্ত্রাস দমন নয়, বরং পুরো ইসলামি বিশ্বের কল্যাণের চিন্তা মাথায় রেখে এবং অমুসলিম বিশ্বের আক্রমণ থেকে মুসলিম বিশ্বকে নিরাপদ রাখার এক সু-মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই একটি মুসলিম সামরিক জোট গঠন করতে হবে। ন্যাটোর মধ্যে একটি ধারা আছে, যদি ন্যাটোভুক্ত কোনো সদস্য রাষ্ট্র অন্য কোনো শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে বুঝতে হবে সকল ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছে। এই কথা মনে করেই ন্যাটোভুক্ত সকল রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ঠিক এরকম একটি ধারার ভিত্তিতেই একটি মুসলিম সামরিক জোট গঠন করতে হবে। যেখানে ন্যাটো ধারার ন্যায় একটি ধারা থাকবে যে, যদি ঐ সামরিক জোটভুক্ত কোনো মুসলিম রাষ্ট্র শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে মনে করতে হবে সকল মুসলিম রাষ্ট্রই আক্রান্ত হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ শত্রুর মোকাবিলা করবে। সামরিক জোটভূক্ত সকল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ অমুসলিমদের স্বার্থের বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অমুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবে।
এখন প্রশ্ন হলো আমাদের পক্ষে এমন জোট গঠন সম্ভব কি-না। আমি বলব, যদি অমুসলিম বিশ্ব দ্বারা সম্ভব হয় তাহলে মুসলিম বিশ্ব দ্বারাও অবশ্যই সম্ভব হবে। আর এটাতো মুসলমানদেরই আদর্শ ও বৈশিষ্ট। রাসূল (সা.) এক হাদীসে উল্লেখ করেছেন, ‘সমস্ত মুসলমান একটি দেহের অঙ্গের ন্যায়; দেহের একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে যেমনিভাবে পুরো দেহ ব্যথিত ও আহত হয় ঠিক তদ্রুপ মুসলিম উম্মাহর একজন মুসলমানের ব্যথায় ব্যথিত ও আহত হবে পুরো উম্মাহ।’ মুসলমানদের আদর্শ ও বৈশিষ্ট হবে এমনই। কিন্তু অতি দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলমানদের এই আদর্শ আজ অমুসলিমরা ধারণ করে নিয়ে গেছে। যে ইহুদি ও খিষ্ট্রান এক সময় তাদের মধ্যে ছিল দা-কুমড়ার সম্পর্ক আজ তারা অতীতের সকল তিক্ততা ভুলে গিয়ে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। কিন্তু পারছি না আমরা। দিন দিন এই উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে আরো তীব্র রূপ ধারণ করছে। যা সত্যিই মুসলিম উম্মাহর জন্য বড়ই অশনি সঙ্কেত।
এই একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের শাসকদের নিকট মজলুম, নির্যাতিত, নিপীড়িত ১৬০ কোটি মুসলমানের করুণ আর্তনাদ হলো, ভবিষ্যৎ ঐক্যবদ্ধ ইসলামি বিশ্ব গড়া ও তাকে নিরাপদ রাখার জন্য এমন একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করুক মুসলিম উম্মাহর ধিপতীরা। তারা গঠন করুক একটি মুসলিম সামরিক জোট। যা হবে মুসলিম উম্মাহর রক্ষার হাতিয়ার।
সম্মানিত পাঠকগণ! আমি যখন এই লেখাগুলো লিখি তখন ছিল ২০১৬ এর শেষ এবং ১৭ এর শুরু। আমরা ২০১৮ এর মার্চে এসে জানতে পারলাম বর্তমান সময়ের সাহসী মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক, সালাউদ্দীন আইয়ূবীর যোগ্য উত্তরসূরী তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান রজব তাইয়েপ এরদোগান এরকমই একটি সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি পশ্চিমাদের আগ্রসন মোকাবিলায় ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী নিয়ে ইসলামি আর্মি নামক একটি মুসলিম সামরিক জোট গঠন করতে যাচ্ছেন। যা হলো উম্মাহর একটি বহু আকাঙ্খিত একটি বলিষ্ট পদক্ষেপ। এজন্য এরদোগানের প্রতি রইলো উম্মাহর পক্ষ থেকে বিনম্র সালাম।
সর্বশেষ আহ্বান
মুসলিম অধিপতীদের প্রতি আমাদের সর্বশেষ আহ্বান হলো, আপনারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথ অবলম্বন করুন। দজলা ও ফুরাত নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। এবার সকল তিক্ততাকে নিজেদের থেকে ঝেড়ে ফেলুন। অভ্যন্তরীণ সকল কোন্দল ও দ্বন্দ্বকে মাটির নিচে চাপা দিন। নিজেদের সামান্য স্বার্থের চেয়ে ১৬০ কোটি মুসলমানের স্বার্থকে বড় করে দেখুন। তাদের মনের ভাষা ও হৃদয়ের আকুতিকে বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনাদের সবকিছু আছে, আছে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশাল ভূখণ্ড, এক বিরাট জনসংখ্যা। কিন্তু নেই ঐক্য ও একতা। আজ সময়ের বড় দাবি হলো, আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। রক্ষা করুন মুসলিম উম্মাহকে। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।