রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে নজরুলের স্বতন্ত্র ভূবন
ড. সলিমুল্লাহ খান
সাহিত্যের ব্যবসায়ে নামিবার একেবারে গোড়াতেই যাঁহার সাহচর্য লাভ করিয়া কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিশেষ লাভবান’ হইয়াছিলেন তাঁহার ভালো নাম মুজফ্ফর আহমদ । উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে লেখা কথা দুটি সুশীলকুমার গুপ্ত মহাশয়ের। তাঁহার বাক্য আরও দুই প্রস্ত উদ্ধার করিলে অন্যায় হইবে না। গুপ্ত মহাশয় প্রকাশ করিতেছেন:
‘মুজফ্ফর আহমদ শুধু একজন জনগণ-বন্ধু ও প্রসিদ্ধ শ্রমিক নেতাই নন, তাঁর মত সাহিত্যপ্রাণ ও দরদী বন্ধু সত্যই দুর্লভ। এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মুজফ্ফর আহমদের বৈপ্লবিক আদর্শে অনেকাংশে প্রেরণা গ্রহণ করে নজরুল অগ্নিবীণা হাতে বাংলা কাব্যের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতীয় চারণের বেশে।’ [গুপ্ত ১৩৮৪:২৯]
আর স্বয়ং মুজফ্ফর আহমদই লিখিয়াছেন, ‘নজরুল ইসলাম নিছক কবি ও সাহিত্যিক ছিল না।’ অর্থাৎ তাঁহার একটি ছকও ছিল। কি সেই ছকটি? এতদিনে সে ছকের কথা সবাই জানিয়া গিয়াছেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহার জীবন প্রভাতে কেন, মধ্যাহ্নেও সে কথা সকলে জানিতেন কিনা সন্দেহ। মুজফ্ফর আহমদ জানাইতেছেন, ‘সে যে রাজনীতিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সৈনিকও ছিল এ কথা তার কোনো কোনো সাহিত্যিক বন্ধু বুঝতে চাইতেন না। তাঁদের মধ্যে কবি শ্রীমোহিতলাল মজুমদারও ছিলেন।’ [আহমদ ১৩৬৬:২৪]
নজরুল ইসলামের কবি প্রতিভা সম্বন্ধে মুজফ্ফর আহমদের একটা প্রস্তাব আছে। সেই প্রস্তাবানুসারে ‘কবিরূপী নজরুল’ ও Ôস্বাধীনতার সৈনিক নজরুলের—এই দুই নজরুলের সম্বনয় যেখানে হইয়াছিল সেখানেই তাঁহার কবি প্রতিভা আশ্চযর্রূপে বিকশিত হইয়াছিল। ১৯২০ সালের মধ্যভাগে [প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ১২ জুলাই তারিখে] মুজফ্ফর আহমদ আর কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হইতে শুরু করে। পত্রিকার আয়ু দীর্ঘ হয় নাই—এ কথা সত্য, কিন্তু তাঁহার ছাপ দীর্ঘদিন থাকিয়া গিয়াছে। কারণের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁহার অনন্তগামী প্রতিভা। ‘বাঙলা দেশে নজরুলের মতো ভাগ্যবান কবি’ মুজফ্ফর আহমদের ধারণা ‘বোধ হয় আর কেউ জন্মাননি।’ তিনি লিখিয়াছেন:
মাসিক পত্রে মাত্র কয়েকটি কবিতা ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের কবি খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। সে এক রকম রাতারাতি বাঙলার খ্যাতিমান কবিদের সঙ্গে আসন পেয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ তখন জীবিত, তাঁর প্রতিভা দিকে দিকে বিকীর্ণ। নজরুলের কণ্ঠে তখন গীত হচ্ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত! প্রসিদ্ধ রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক শ্রীহরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সে তখন পরিচিত হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে একত্রে গানও গাইছে। সে মুখে আবৃত্তি করছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। এমন কি রবীন্দ্র কবিতার প্যারোডি ক’রে সে ‘নবযুগ’-এর হেডিং পর্যন্ত দিচ্ছে। যেমন-
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরান সখা ফৈসুল হে আমার।
ফৈসুল [ওরফে ফয়সাল] ইরাকের রাজা ছিলেন। এই নজরুল, বাইশ বছরের যুবক হঠাৎ কিনা রচনা করল এমন সব কবিতা যে সব সম্পূণর্রূপে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত, যে সব সম্পূণর্রূপে তার একান্ত নিজস্ব। তাই তো সে রাতারাতি কবি প্রসিদ্ধি লাভ করত পারল।’ [আহমদ ১৩৬৬: ২৪-২৫]
প্রশ্ন হইতেছে: কি যাদু বলে নজরুল ইসলাম রবীন্দ্র প্রভাবের বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন? ইহার একপ্রস্ত জবাব—আমরা আগেই ইশারা করিয়াছি—মুজফ্ফর আহমদ লিখিয়াছেন। পড়ি তাঁহার বাক্যে: ‘এই সাহিত্যিক বন্ধুদের [ইঁহাদের মধ্যে কবি মোহিতলাল মজুমদারও ছিলেন] এটা লক্ষ করা উচিত ছিল যে কেন ‘নবযুগ’-এ কাজ করার সময়ে নজরুলের কবি প্রতিভা এমন আশ্চর্যরূপে বিকশিত হয়েছিল। এখানে দুই নজরুলের সমন্বয় ঘটেছিল—কবিরূপী নজরুলের ও স্বাধীনতার সৈনিক নজরুলের। তাই নজরুল এই সময়ে কবিতার এমন বিচিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিল, যে সৃষ্টি তার অভিনবত্বে সমস্ত দেশকে চমকে দিল।’ [আহমদ ১৩৬৬:২৪]
নজরুল ইসলামকে যাঁহারা গোড়াতেই ভুল বুঝিয়াছিলেন তাঁহাদের আদর্শ বা নমুনা [যাহাই বলুন] ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। মোহিতলাল মজুমদারের সহিত নজরুল ইসলামের তুলনা করিয়াছেন মুজফ্ফর আহমদ। মোহিতলালের যে ছবি মুজফ্ফর আহমদ আঁকিয়াছেন তাহা খুটাইয়া দেখিলে তাঁহাকে বিলক্ষণ চেনা যায়। ‘মুখচেনা বুদ্ধিজীবী’ পরিচয়ে। ‘মুখচেনা বুদ্ধিজীবী’ কথাটা আমি এস্তেমাল করিতেছি ইতালীয় বুদ্ধিজীবী মহাত্মা আন্তনিয়ো গ্রামসির লেখা হইতে। ‘মুখচেনা’ শব্দের ইংরেজি তর্জমা ‘ট্র্যাডিশনাল’। মোহিতলালকে তাই ‘মুখচেনা বুদ্ধিজীবী’ বলিতে বিশেষ অন্যায় নাই। বিশেষত মুজফ্ফর আহমদ লিখিয়াছেন:
মোহিতলাল ছিলেন অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক লোক। তাঁর পরিচয়ের পরিধি ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অল্পসংখ্যক সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক লোকের সঙ্গেই তিনি শুধু মেলামেশা করতেন। তার বাইরে তাঁর পরিচয় ছিল তাঁর স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে। তিনি ছিলেন হাইস্কুলের হেড মাস্টার। এক সময়ে তিনি বন্দোবস্ত বিভাগের কানুনগো ছিলেন। সেই সময়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাঁর কিছু সংযোগ ঘ’টে থাকবে, তার পরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার আর কোনো সংযোগ ছিল না। তাঁর মধ্যে পসন্দ-অপসন্দের মনোভাব এত প্রবল ছিল যে, সাহিত্যিকদের মধ্যেও বেশীর ভাগ লোকের সঙ্গে তিনি মিশতে পারতেন না। [আহমদ ১৩৬৬: ৪৬]
আর নজরুল ইসলাম ছিলেন, মুজফ্ফর আহমদের বিচারে, ‘মোহিতলালের সম্পূর্ণ উল্টা’। আমরা সেই হিসাবে নজরুল ইসলামকে জনসাধারণের পরমাত্মীয় বা ‘আত্মার আত্মীয়’ বুদ্ধিজীবী বলিতে পারি। ‘আত্মার আত্মীয়’ কথাটা এখানে আমি আন্তনিয়ো গ্রামসি প্রবর্তিত ‘অর্গানিক’ শব্দের কাজ চালাইবার যোগ্য তর্জমারূপে গ্রহণ করিতেছি। মুজফ্ফর আহমদের সাক্ষ্যও আমার এই প্রস্তাবের পথ পরিষ্কার করিয়াছে। তিনি লিখিয়াই গিয়াছেন, ‘সকল স্তরের লোকের সঙ্গে তার মতো ব্যাপক পরিচয় কম লোকেরই ছিল। যাঁরা নজরুলের কবিতা বোঝেননি তাঁরা তার কবিতার সুর, ধ্বনি ও ছন্দ ঝঙ্কারে মুগ্ধ হয়েছেন। তাই হয়ে তাঁরা আরও বেশি তার কবিতা শুনতে চেয়েছেন; অশিক্ষিত সাধারণকেও নজরুল তার গানের দ্বারা আকর্ষণ করেছে। সে শুধু গায়ক ছিল না হাজার হাজার গানের সে রচয়িতাও। এই কারণে নজরুল সর্বস্তরের মানুষের—বহু মানুষের কবি হতে পেরেছেন। আর মোহিতলাল শুধু বিদগ্ধ সমাজের অর্থাৎ গণিতসংখ্যক মানুষের কবি। [আহমদ ১৩৬৬: ৪৭]
মুখচেনা বা গণিত বুদ্ধিজীবীর সহিত গণদেবতা বা পরমাত্মীয় বুদ্ধিজীবীর যে ভেদ মোহিতলালের সহিত নজরুলের ভেদও ছিল সেই গোছেরই। মুজফ্ফর আহমদই তাহা পরিষ্কার করিয়া বলিয়াছেন। আমরা পড়িতেছি: ‘নজরুল জনগণের প্রতিনিধি ছিল। মোহিতলাল তা ছিলেন না এবং চেষ্টা করলেও তাঁর স্বভাবের দোষে তিনি তা হতে পারতেন না। অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে নজরুল ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সৈনিক। এখানেও তার সঙ্গে মোহিতলালের বিরাট পার্থক্য ছিল। রুশিয়ার সর্বহারা বিপ্লবকে নজরুল মনে-প্রাণে সমর্থন করেছে, নানাভাবে সে-বিপ্লবের বন্দনা সে করেছে। এই ব্যাপারেও তার সঙ্গে মোহিতলালের মিল ছিল না।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৪৭]
‘মোহিতলাল মজুমদার নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে স্নেহান্ধ ছিলেন। খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেও তিনি নজরুলের স্বভাব কেন যে বোঝেননি তা ভেবে আজও আমি আশ্চর্য হয়ে যাই’—এই আক্ষেপও করিয়াছেন মুজফ্ফর আহমদ। [আহমদ ১৩৬৬: ৪৭-৪৮]
মোহিতলালের ভুলটা কোথায় তাহাও দেখাইয়া দিয়াছেন মহান মুজফ্ফর আহমদ। লিখিয়াছেন, ‘তিনি প্রাণপণে নজরুলকে নিজের আকৃতিতে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকলেন। এই ভাবে গঠিত হওয়ার মানে আত্ম-বিলুপ্তি। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনও ব্যক্তি কি তা সহ্য করতে পারে?’ [আহমদ ১৩৬৬:৪৯]
শুদ্ধ কি তাহাই? ‘মোহিতলাল নজরুলকে শেলি, কীট্স, বায়রন আর ব্রাউনিং পড়তে বলতেন তার ‘বুদ্ধির দীপায়নের জন্যে’। দূরে থেকে যাঁরা শুনবেন তাঁরা বলবেন ভালোই তো বলতেন মোহিতলাল। কিন্তু নজরুলের জন্যে বিদেশি কবিদের কাব্য চর্চার প্রয়োজন ছিল কি? সে ছিল আমাদের দেশের মাটির সন্তান। দেশের মাটি হতেই রস গ্রহণ করত সে। মাটির কাছাকাছি যে কবির বাণী শোনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ কান পেতে ছিলেন নজরুল ছিল সেই কবি।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৪৯]
২
মোহিতলাল মজুমদারের কথা এতখানি জুড়িয়া বলিবার আরও একটা কারণ আমার মাথায় আছে। এই কারণের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মুজফ্ফর আহমদ আক্ষেপ করিয়াছেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াও মোহিতলাল নজরুল ইসলামকে অথবা বলা যাউক তাঁহার স্বভাবকে বুঝিতে পারিলেন না। তাহা হইলে কে তাহাকে বুঝিতে পারিয়াছিলেন? মুজফ্ফর আহমদ উত্তরে বলিয়াছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ’। মুজফ্ফর আহমদ প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ। আমরা সবিনয়ে নিবেদন করিব তাঁহার এই উত্তরটি কিন্তু অসত্য, বড় জোর অর্ধসত্য। তাঁহার আপনকার কথাই তাঁহার ধারণাকে অসত্য প্রমাণ করিতেছে।
মুজফ্ফর আহমদ লিখিয়াছেন, ‘কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দূরে থেকেও নজরুলকে বুঝেছিলেন।’ প্রমাণ? তিনি নিবেদন করিতেছেন, ‘কবি রূপে প্রথম পরিচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নজরুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিল এবং তার স্নেহও সে পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নজরুল ছেলেদের কিছু কিছু ড্রিল শেখাবে। আর দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটে গান শিখবে।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৪৮]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে গান শিখাইতে চাহিয়াছিলেন। ইহাতে স্নেহের প্রমাণ অকাট্য। কিন্তু তাঁহার সব্যসাচী প্রতিভার মধ্যে শুদ্ধ ড্রিল শিখাইবার দক্ষতাই জ্যেষ্ঠকবির দৃষ্টি কাড়িয়াছিল ভাবিতে গা ছমছম করে। আজও করে। শান্তিনিকেতনে নজরুলকে কি একটি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান যাইত না? ১৯৩৫ সালে কাজী আবদুল ওদুদকে কি নিজাম বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ করা হয় নাই? কথা বাড়াইলে আরও বাড়াইতে পারি। কিন্তু বাড়াইবার সময় আসে নাই।
মুজফ্ফর আহমদ কহিতেছেন, ‘এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচার কথাটা বলেছিলেন। তিনি সম্ভবত নজরুলের কাব্য-সাধনা ও রাজনীতিক সংগ্রামে সমন্বয়ের চেষ্টা দেখে এই কথাটি ব’লে থাকবেন।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৪৮]
তলোয়ার দিয়া দাড়ি চাঁছিবার গল্পটি এতদিনে পুরাতন হইয়া গিয়াছে। তথাপি তাঁহার তাৎপর্য এখনও তাজাবতাজা রহিয়াছে বলিয়া ভ্রম হয়। কথাটি নানান জনে নানান ভাবে বয়ান করিয়াছেন। একটা বয়ান পাওয়া যাইতেছে সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায়। তাঁহার লেখার কিছু অংশ সুশীলকুমার গুপ্ত উদ্ধার করিয়াছেন। নিবেদন করি:
‘জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবার সময় তেমন-তেমন বড়লোককেও সমীহ করে যেতে দেখেছি, অতি বাকপটুকেও ঢোক গিলে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু নজরুলের প্রথম ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভাব সে যেন ঝড়ের মত। অনেকে বলত, তোর এসব দাপাদাপি চলবে না জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, সাহসই হবে না তোর এমনিভাবে কথা কইতে। নজরুল প্রমাণ করে দিলে যে সে তা পারে। তাই একদিন সকালবেলা “দে গরুর গা ধুইয়ে” এই রব তুলতে তুলতে সে কবির ঘরে গিয়ে উঠল। কিন্তু তাকে জানতেন বলে কবি বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট হলেন না। শুনেছি অনেক কথাবার্তার পর কবি নাকি বলেছিলেন, “নজরুল, তুমি নাকি তরোয়াল দিয়ে আজকাল দাড়ি কামাচ্ছ—ক্ষুরই ও-কাযের্র জন্যে প্রশন্ত—এ কথা পূর্বাচার্যগণ বলে গেছেন”।’ [গুপ্ত ১৩৮৪: ৩০; চট্টোপাধ্যায় ১৩৫১: ৩৮]
এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদের ভাষ্য এই রকম: ‘রবীন্দ্রনাথ একবার নজরুলকে তলওয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন তিনি সত্যই। কিন্তু কথাটা নানান জনে নানানভাবে লিখেছেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এক জায়গায় কথাটা লিখেছেন। আমি নজরুলের মুখে যা [শুনেছিলেম] তা হচ্ছে এই যে, সাক্ষাতের প্রথম দিনেই রবীন্দ্রনাথ কথাটা নজরুলকে বলেছিলেন। তখনও তিনি ভাবেননি যে, নজরুল গভীরভাবে রাজনীতিক সংগ্রামে বিশ্বাসী। নজরুল কবি, কাব্যচর্চাই তার পেশা হওয়া উচিত। তার মানে রাজনীতিতে তার যাওয়া উচিত নয়—এইসব ভেবেই তিনি তলওয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচার কথাটা বলেছিলেন। অন্তত নজরুল তাই বুঝেছিল। রবীন্দ্রনাথ শুধু ওই কথা বলেই চুপ করে যাননি। তিনি তার সঙ্গে একটি প্রস্তাবও দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, নজরুল শান্তিনিকেতনে চলুক। সেখানে সে ছেলেদের কিছু কিছু ড্রিল শেখাবে আর গান শিখবে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।’ [আহমদ ১৯৭৩:২৪০]
‘কিন্তু’, মুজফ্ফর আহমদ দাবি করিতেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পরে নজরুলের ঝোঁক ধরতে পেরেছিলেন। তাই নজরুল যখন ‘ধূমকেতু’ বার করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ভিক্ষা করেছিল তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে রাজনীতিক আশীর্বাদই করেছিলেন। তার আশীর্বাণীর সেই ক’টি ছত্র অনেকেরই মুখস্থ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
কাজী নজরুল ইসলাম
কল্যাণীয়েষু,
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা।
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন!
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৪ শে শ্রাবণ, ১৩২৯ [আহমদ ১৩৬৬: ৪৮]
‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বাহির হইল ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট তারিখে। [আহমদ ১৯৭৩: ২৪১] মুজফ্ফর আহমদ আরেক জায়গায়ও লিখিয়াছেন, “কিন্তু ‘ধূমকেতু’র জন্যে নজরুল যখন রবীন্দ্রনাথের নিকট হতে বাণী চাইল তখন তিনি তাকে বুঝে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে, সে নিজে যে-পথ বেছে নিয়েছে তাকে সেই পথে যেতে দিলেই সে বিকশিত হবে। তাই রবীন্দ্রনাথ যে-বাণী নজরুলকে পাঠিয়েছিলেন সেটা ছিল নজরুলের প্রতি তাঁর রাজনীতিক আশীর্বাদ।’ [আহমদ ১৯৭৩: ২৪০]
নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটি ১৯২৬ কি ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘সর্বহারা’ নামধেয় কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায়। সেই কবিতার সাক্ষ্য কিন্তু মুজফ্ফর আহমদের কথাটিকে সত্য প্রমাণ করে না।
‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার গোড়ার দিকেই রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণ করিয়াছেন নজরুল ইসলাম। নজরুলের রাজনীতি ও জাতীয়তার সাধনা দুই বস্তুকেই যে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইয়াছিল তাহার পুরানা পাথুরিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় এই কবিতায়। যথা:
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হ’চ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে।
পড়ে না’ক বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়ি চাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে। হিন্দুরা ক’ন, ‘আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!”
[ইসলাম ২০০৫: ৭১; ইসলাম ২০০৭: ২৩; ইসলাম ১৯৯৬ (১): ২৯২-২৯৩]
দেখা যাইতেছে তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছিবার কাজটা নজরুল ইসলাম চালাইয়া গেলেন, অন্তত বন্ধ করিলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ গুণে তাঁহাকে বুঝিতে পারিয়া ‘রাজনীতিক আশীর্বাদ’ পাঠাইলেন। এখানেই প্রশ্ন তুলিবার একটুখানি অবসর আছে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার রাজনীতিটা কি ছিল? খোদ মুজফ্ফর আহমদ এ ব্যাপারে কি বলেন?
মুজফ্ফর আহমদ নিজে কি ‘ধূমকেতু’র রাজনীতি সমর্থন করিতেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের অবশ্যই বলিতে হইবে, ‘না’। এই ‘না’ উত্তরটি আরও বড় হইয়া বাজিবে যখন জানিব নজরুল ইসলাম একদা মুজফ্ফর আহমদের সহিত যুগ্ম সম্পাদকতা করিয়া ‘নবযুগ’ বাহির করিয়াছিলেন। আবার ১৯২৫ ও ১৯২৬ সাল নাগাদ প্রথমে ‘লাঙ্গল’ এবং পরে ‘গণবাণী’ বাহির করিয়াছিলেন তাঁহারা। গণ্ডগোলের মধ্যে ‘ধূমকেতু’। মুজফ্ফর আহমদের লেখা পড়িয়াই আমরা জানিয়াছি, “‘ধূমকেতু’তে জনগণের কথা একেবারেই বলা হতো না, এটা মোটেই ঠিক কথা নয়। তবে ‘ধূমকেতু’র মারফতে নজরুল মূলত তার আবেদন জানাচ্ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত তরুণদের বরাবরে। নিরুপদ্রব অসহযোগ আন্দোলনের খাতিরে বাংলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা তাঁদের কার্যকলাপ বন্ধ রেখেছিলেন। নজরুলের আবেদন আসলে পৌঁছে যাচ্ছিল তাঁদেরই নিকটে।” [আহমদ ১৯৭৩: ২৪১]
‘ধূমকেতু’ পত্রিকা বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদের আরও কথা আছে। এই পত্রিকা, তাঁহার বিচারে, জনগণের নিকটে পেটৗছাইতে পারে নাই। মুজফ্ফর আহমদ জানাইতেছেন: “শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণীর ভিতরে তার প্রচার সীমাবদ্ধ ছিল। এখানেই ‘ধূমকেতু’ খুব বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরাও এই শ্রেণীর লোক। কাজেই, নজরুলের আবেদনে তাঁরাই নূতন করে চেতনা লাভ করেছিলেন।” [আহমদ ১৯৭৩: ২৪১]
এই প্রস্তাবের সাফাই সাক্ষ্য দিবার ছলে মুজফ্ফর আহমদ আরও গাহিয়াছেন, ‘এটা আমার অনুমানের কথা নয়। শুধু যে তরুণেরা নজরুলের নিকট আসছিলেন তা নয়, সন্ত্রাসবাদী “দাদা”রাও [নেতারা] এসে তাকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছিলেন। ১৯২৩-২৪ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন আবার যে মাথা তুলল, তাতে নজরুলের অবদান ছিল। এ কথা বললে বোধ হয় অন্যায় করা হবে না। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দুটি বড় বিভাগের মধ্যে “যুগান্তর” বিভাগের সভ্যরা তো বলেছিলেন, “ধূমকেতু” তাঁদেরই কাগজ।’ [আহমদ ১৯৭৩: ২৪১-২৪২]
‘অনুশীলন’ দলের শ্রীঅতীন রায়চৌধুরীও ‘ধূমকেতু’কে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন। [আহমদ ১৩৬৬: ৮২] এককথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্শীবাদ—‘জাগিয়ে দেরে চমক মেরে/ আছে যারা অর্ধ্বচেতন’—ফলিয়াছিল।তাহাতে নজরুলের লেখা পড়িয়া বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী যুবকেরা সত্যই চমকিয়া উঠিয়াছিলেন। [আহমদ ১৩৬৬: ৮৬] মুজফ্ফর আহমদ অকপট লিখিয়াছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি নজরুলের বড় আকর্ষণ ছিল।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৮২]
৩
এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে, কাজী নজরুল ইসলামের রাজনীতিটা কী বস্তু ছিল? ইহার উত্তর খানিক জোগাইয়াছেন মুজফ্ফর আহমদ। তিনি লিখিয়াছেন, ‘১৯২২ সালের ভদ্রশ্রেণীর মধ্যে যাঁরা রাজনীতি করতেন তাঁদের ধারণা ছিল যে, দেশের মুক্তি শুধু তারাই আনতে পারবেন, আর মজুর ও কৃষকেরা গড্ডলিকা প্রবাহের মতো তাঁদের অনুসরণ করবেন। যাঁরা রাজনীতি করতেন না তাঁরা তো মজুর-কৃষকের নাম শুনলেই নাক সিঁটকাতেন। আজ অবস্থায় বিপুল পরিবর্তন এসেছে। ভদ্রলোকেরা এখন মজুরে পরিণত হচ্ছেন। নজরুল ইসলামের চেতনায়ও পরিবর্তন এসেছিল। ১৯২২ সালের পরে মজুর, কৃষক ও জনগণকে বাদ দিয়ে নজরুলকে কল্পনা করাই যেত না।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৮৫]
নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’র সঙ্গে মুজফ্ফর আহমদের কোনো সাংগঠনিক যোগ ছিল না। ‘তার মানে’, মুজফ্ফর আহমদ লিখিতেছেন, ‘তার পরিচালনায় ও নীতিনির্ধারণে আমার কোনও হাত ছিল না।’ তবে তিনি হামিশা ‘ধূমকেতু’ অফিসে যাইতেন। অনেক সময় রাত্রে সেখানে বাসও করিতেন। তাহার পরও তিনি কবুল করিয়াছেন, ‘নজরুল যে শুধুই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের নিকট তার আবেদন জানাচ্ছিল তার একটা উল্টো প্রতিক্রিয়া আমার ভিতরে হয়েছিল।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৮৩] সম্পাদকের নামেও গ্রেফতারি পরোয়ানা বাহির হইলে তখন মুজফ্ফর আহমদ নজরুল ইসলামকে রক্ষা করিতে আগাইয়া আসিলেন। পরোয়ানা জারি হইবার কয়েকদিন আগে হইতেই কয়দিন ধরিয়া কেবলই গুজব রটিতে লাগিল যে নজরুল ইসলামের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বাহির হইবে। বন্ধুদের অনেকে বলিলেন নজরুল কিছুদিন সরিয়া থাকিলে ভালো হয়। মুজফ্ফর আহমদ লিখিয়াছেন, ‘আমি বললাম, “তুমি যদি সরেই থাকতে চাও তবে চেষ্টা করে দেখা যাক তোমায় মস্কো পাঠানো যায় কি না।” কমিউনিস্ট ইন্টরন্যাশনালে ভারতীয় ব্যাপারের যাঁরা চার্জে ছিলেন নজরুলের লেখার সংগ্রামশীলতা তাঁদের আকর্ষণ করেছিল। তাঁরাই জানিয়েছিলেন নজরুলকে একবার পাঠাতে পারলে মন্দ হয় না।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৮৬] নজরুল গা করিলেন না। গা ঢাকাও দিলেন না। কলিকাতা ছাড়িলেন, কিন্তু গেলেন কোথায়? মস্কো না, মাত্র কুমিল্লা।
শুধু এই কারণে নহে, আর আর পাঁচ কারণেও মুজফ্ফর আহমদ একটু চটিয়া ছিলেন। তাঁহার জবানীতেই শুনি সেই কাহিনী। তিনি লিখিতেছেন, ‘১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে নজরুল আর আমি ঠিক করি যে, আমরা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে এগিয়ে যাব। পড়াশুনা করব বলে সামান্য কিছু পুঁথিপুস্তকও কিনেছিলাম। এই ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ লিখেছিল। কিন্তু ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নজরুল কুমিল্লায় চলে গিয়ে অনেক দিন সেখানে থাকল। সেই সময়ে চিঠিপত্রের ভিতর দিয়ে তার সঙ্গে আমার কিঞ্চিত চটাচটিও হয়ে গেল।’ [আহমদ ১৯৭৩: ২৪৮]
পরক্ষণেই মুজফ্ফর আহমদ লিখিতেছেন, ‘অবশ্য, এমন কোনো চটাচটি নয় যার জন্যে আমাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে। কুমিল্লা গিয়ে নজরুল যে ‘প্রলয়োল্লাস’ লিখেছিল সেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিকই ছিল। কিন্তু কলকাতায় ফিরে এসে ‘ধূমকেতু’তে লিখতে গিয়ে নিজের প্রচণ্ড আবেগের স্রোতে সে নিজেই ভেসে গেল। সে যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করবে স্থির করেছিল তার সেই বিবেককে সে লাল পোশাক পরে, লাল কালিতে লিখে, এবং মাঝে মাঝে লাল নিশানের কথা বলে ঠিক রাখছিল।’ [আহমদ ১৯৭৩: ২৪৮]
এক্ষণে মুজফ্ফর আহমদ সিদ্ধান্ত টানিতেছেন। তাঁহার ধারণা, “কিন্তু নজরুল যদি গিরেফ্তার না হতো এবং তার ‘ধূমকেতু’ যদি চলতে থাকত তবে তার লেখা তাকে বদলাতে হতো। এই জাতীয় লেখা ক্রমাগত লেখা যায় না। ভিতরের আবেগ নিঃশেষ হয়ে আসে। তখন নজরুলকে জনগণের দিকেই ঝুঁকতে হতো।’ [আহমদ ১৯৭৩: ১৪৮]
মুজফ্ফর আহমদের এই অনুমান বা প্রার্থনা পুরাপুরি কল্পনার ফসল নহে আর মোহিতলাল মজুমদারের উপদেশও বৃথা যায় নাই। ‘পড়ে না’ক বই, বয়ে গেছে ওটা’—কথাটাও গোটা গোটা বেদবাক্য হয় নাই। শ্রমিকের ওপর লেখা ইংরেজ কবি শেলির কবিতা বা গানের ভাবানুবাদও নজরুল ইসলাম করিয়াছিলেন। ১৯২৭ সালের ৫ মে তারিখের ‘গণবাণী’ হইতে তাহার উদ্ধৃতি প্রকাশ করিয়াছেন মুজফ্ফর আহমদ। আমরাও তাহা এখানে আবার তুলিয়া দিতেছি।
ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!
অলিখিত যত গল্প কাহিনী তোরা যে নায়ক তারি।।
শক্তিময়ী সে এক জননীর
স্নেহ সূত সব তোরা যে রে বীর।
পরস্পরের আশা যে রে তোরা,
মা’র সন্তাপহারী।।
নিদ্রোত্থিত কেশরীর মত
উঠ্ ঘুম ছাড়ি নব জাগ্রত!
আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী।।
ঘুম ঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল
দেহ মন বেঁধে করেছে বিকল,
ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির বারি।
উহারা ক’জন? তোরা অগণন, সকল শক্তিধারী।। [আহমদ ১৩৬৬: ৪৯]
নজরুল ইসলাম শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের যে বাংলা তর্জমা করিয়াছিলেন—জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!—তাহার তুলনা আজও নাই। আমাদের যুগের আরেক অমর গল্প-মহাত্মা ফ্রান্স ফানোঁ রচিত ‘লে দাম্নে দু লা তের’ [খবং উধসহল্কং ফব ষধ ঞবৎৎব] অনুবাদের শিরোনামায়ও নজরুলের অমর বাক্য ‘জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত’ নিয়োগ করা হইয়াছে। [ফানোঁ ১৯৮৮]
গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে চীন দেশের নেতা জিয়াং জিয়েসি [Jiang Jieshi, ১৮৭৭-১৯৭৫] [তৎকালে ইঁহার নাম চিয়াং কাইশেক বলিয়া প্রচারিত হইত] ভারত সফরে আসিয়াছিলেন। তখন তাঁহার বন্দনার্থে একপ্রস্ত গান রচনার অনুরোধ গ্রামোফোন কোম্পানির তরফ হইতে করা হইল নজরুল ইসলামকে।
১৯৫৯ সালের স্মৃতিকথায় মুজফ্ফর আহমদ সে কথা স্মরণ করিয়া লিখিতেছেন, ‘আজ যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নজরুল হতবাক ও হৃত-সন্বিব্দৎ হয়েছে সে ব্যাধির আক্রমণ তখন তার শরীরে শুরু হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও নজরুল গান রচনা করেছিল।’ মুজফ্ফর আহমদের মন্তব্য: ‘এবং এই গানটি চিয়াং কাইশেকের বন্দনা নয়। যিনিই গানটি পড়বেন তিনি বুঝতে পারবেন যে তা আসলে চীন ও ভারতের নিপীড়িত মানুষের বন্দনা।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৭৪]
পুরো গানটি তুলিয়া দেওয়ার মতো। নজরুল রচনাবলীতেও এই গানটি সসম্মানে সংকলিত হইয়াছে। মুজফ্ফর আহমদ বলিয়াছেন, ‘এটি নজরুলের লেখা শেষতম গান কি-না তা বলা শক্ত, তবে তার শেষ লেখাগুলির মধ্যে এই গানটি যে অন্যতম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।’ [আহমদ ১৩৬৬: ৭৪]
চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শত কোটি লোক।
চীন ভারতের জয় হোক! ঐক্যের জয় হোক! সাম্যের জয় হোক!
ধরার অর্ধ নর-নারী মোরা রহি এই দুই দেশে,
কেন আমাদের এত দুর্ভোগ নিত্য দৈন্য ক্লেশে,
সহিব না আর এই অবিচার, খুলিয়াছে আজি চোখ।।
চীন ভারতের জয় হোক! ঐক্যের জয় হোক! সাম্যের জয় হোক!
প্রাচীন চীনের প্রাচীর ও মহাভারতের হিমালয়
[আজ] এই কথা যেন কয়,
মোরা সভ্যতা শিখায়েছি পৃথিবীরে
ইহা কি সত্য নয়?
হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দল,
সুন্দর হবে, শান্তি লভিবে, নিপীড়িতা ধরাতল!
আমরা আনিব অভেদ ধর্ম নব বেদগাথা শ্লোক।।
চীন ভারতের জয় হোক! ঐক্যের জয় হোক! সাম্যের জয় হোক!
[আহমদ ১৩৬৬: ৭৪-৭৫; ইসলাম ১৯৯৬ [৩]: ৫৪৭-৫৪৮]
এই গানটির রচনাকাল, নজরুল রচনাবলী অনুসারে, ফেব্রুয়ারি ১৯৪২। শ্রীজগন্ময় মিত্র গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে এই গানটি গাহিয়াছিলেন। [ইসলাম ১৯৯৬ (৩): ৫৪৮]
দোহাই
১. কাজী নজরুল ইসলাম, সঞ্চিতা, পুনর্মুদ্রণ [ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৫]।
২. কাজী নজরুল ইসলাম, সর্বহারা, পুনর্মুদ্রণ [ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৭]।
৩. কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, আবদুল কাদির সম্পাদিত, সংশোধিত সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ [ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬]।
৪. কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, আবদুল কাদির সম্পাদিত, সংশোধিত সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ [ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬]।
৫. ফ্রাঞ্জ ফেনো, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত, আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া অনূদিত [ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮]।
৬. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল প্রসঙ্গে (স্মৃতিকথা), প্রথম সংস্করণ [কলিকাতা: বিংশ শতাব্দী প্রকাশনী, ১৩৬৬/১৯৫৯]।
৭. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, পুনর্মুদ্রণ [ঢাকা: মুক্তধারা, ১৯৭৩]।
৮. সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, ‘আমাদের নজরুল,’ কবিতা [কার্তিক-পৌষ, ১৩৫১]।
৯. সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল-চরিতমানস, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ [কলিকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৩৮৪]।