রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি কটূক্তি: ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষায় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দাল মহানবী (সা.) ও আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.)-কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর মন্তব্য করে গোটা মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের অনুভূতিকে গভীরভাবে আঘাত করেছে। প্রায় ১৬টি মুসলিম দেশ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করে এবং ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা অবিলম্বে অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ভারত সরকারকে মুসলিম উম্মাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে।
ইতোমধ্যে বিজেপি সরকার অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে দল থেকে বহিষ্কার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরিস্থিতি শান্ত করতে বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এটা কোনোভাবেই ভারত সরকারের মনোভাবের প্রতিফলন নয়। ভারত সরকার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাংস্কৃতিক পরম্পরা অনুযায়ী, সমস্ত ধর্মকেই সর্বোচ্চ সম্মান দেয়। এসব কিছু উটকো লোকের কাজ। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবার এক হয়ে কাজ করতে হবে। বিজেপি সমস্ত ধর্মকে সম্মান করে এবং যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তির অবমাননার তীব্র নিন্দা করে। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক অরুণ সিং এক বিবৃতিতে বলেছেন, দল যে কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগকে সম্মান জানায়। কোনো ধর্মের অপমান বিজেপি বরদাস্ত করে না। ভারতের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রতিটি ধর্মেরই বিকাশ ঘটেছে। যে কোনো ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির অবমাননার তীব্র নিন্দা করে বিজেপি (মানবজমিন, ঢাকা ৬ জুন ২০২২)।’ রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে, বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে যেকোনো উস্কানিমূলক কাজ বন্ধ করতে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে।
ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী শক্তির উত্থান পুরো উপমহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ভারতের ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদীরা মূলত ইসলাম বিরোধিতা ও মুসলিম বিদ্বেষকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাবরি মসজিদ দখলের পর উগ্রবাদীরা নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। পবিত্র কুরআন পরিবর্তনের চক্রান্ত, জ্ঞানবাপী মসজিদ, আগ্রার তাজমহল, দিল্লির কুতুব মিনার, আজমির শরিফ দখলের অপচেষ্টায় লিপ্ত।
বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, কর্ণাটকে ছাত্রীদের হিজাব নিষিদ্ধ, গোমাংস রাখার কথিত অপরাধে ৩৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা, বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ধ্বংস সাধন, উত্তর প্রদেশে মসজিদে মাইকে আজান নিষিদ্ধ, আসামে মাদরাসায় সরকারি অনুদান বন্ধ, কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বিষয়ক সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রবর্তন, দেওবন্দ মাদরাসার ফতোয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ মূলত ভারতকে মুসলিম শূন্য করে একক হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। মুসলমানদের বেঁচে থাকার এবং স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ভারতে একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৪ সাল থেকে এবারই ভারত প্রথম প্রচণ্ড কূটনৈতিক চাপে পড়ে ঝাঁকুনি খেল। ধর্মের সাথে অর্থনীতির স্বার্থ বিজড়িত। উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ৮ হাজার ৭ শত কোটি ডলার। কেবলমাত্র ওমানে ৭ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় চাকরি করেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির প্রবাসী রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশি আসে উপসাগরীয় ছয়টি দেশ থেকে। ভারতের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি প্রধান গন্তব্য হলো জিসিসিভুক্ত দেশগুলো। ভারতের এক কোটি ৩৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ৮৭ লাখই থাকে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে।
মিসরের গ্র্যান্ড মুফতি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শপিংমলে ভারতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধ এমন ব্যানার টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে কোলকাতার সংবাদ প্রতিদিন জানিয়েছে, নূপুর শর্মা কর্তৃক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আক্রমণ করার পরিপ্রেক্ষিতে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে ইচ্ছুক ভারতীয়দের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে। কোনও ভারতীয় দর্শককে কাতারে ঢুকতে দেওয়া হবে না। জ্বালানি, ব্যবসা এবং রেমিট্যান্সের জন্য উপসাগরীয় এসব মুসলিম দেশের ওপর ভারত ভীষণভাবে নির্ভরশীল। এসব দেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কও খুবই ঘনিষ্ঠ। ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতির কারণে ভারতের সাথে আরববিশ্বের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি ও মমতা মন্ত্রীসভার সদস্য মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নূপুর শর্মা হলো মুখোশ, মহানবীকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে অন্য কোন মুখ আছে। সিদ্দিকুল্লাহ বলেন, মোদি সরকার ধর্মকে ভিত্তি করে এক বিভাজনের খেলায় মেতেছে। কোটি কোটি ভারতবাসী এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি বাণিজ্য তুলে নিলে ভুগবে কারা? কাতার গ্যাস বন্ধ করলে সংকট কাদের হবে? তিনি বলেন, বিবৃতি দিয়ে নয়, বহিষ্কার করে নয় এমন কিছু করতে হবে যাতে নূপুর শর্মার মতো ব্যক্তিদের কণ্ঠরোধ করা যায় (মানবজমিন, ঢাকা, ১০ জুন ২০২২)।
ইসলামের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান মিসরের আল-আযহার আল-শরীফ তাদের এক বিবৃতিতে নবীকে নিয়ে বিজেপি নেতার বক্তব্যকে ‘সন্ত্রাসী আচরণের’ সাথে তুলনা করে বলেছে, এমন আচরণ পুরো বিশ্বে ভয়াবহ সংকট তৈরির উস্কানি। ‘কিছু কট্টর লোকজনের ভোটের জন্য ইসলামের এমন অবমাননা উগ্রবাদের সমার্থক। এর ফলে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে (নয়াদিগন্ত, ৮ জুন ২০২২)।’
প্রতিবাদকারী দেশগুলো হল, ইরাক, ইরান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, জর্ডান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাহরাইন, মালদ্বীপ, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং তুর্কি। এসব দেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতে ইসলামোফোবিয়ার গুরুতর ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি অবিলম্বে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে। সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে মুসলমানদের তাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের অধিকার ক্ষুন্ন করার জন্য ভারতকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবশ্যই ভারতকে তাদের জাফরানাইজেশনের নিন্দনীয় প্রচার থেকে বিরত করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার চেয়ে ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য মুসলমানরা যেন বঞ্চনার শিকার না হয়।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন