উপমহাদেশে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার
মাহমুদুল হক আনসারী
ধর্ম মানুষের জন্য। ধর্মের অনুশীলন মানুষকে আলোকিত করে। ধর্মের চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তিসমাজ, রাষ্ট্র আলোকিত হয়। সব গোত্র মানুষের একটি ধর্ম থাকে। সব মানুষেই ধর্মের অনুশীলন, অনুকরণ করে। উপমহাদেশের এ অঞ্চলে বহু ধর্মের মানুষের বিচরণ। মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান আরও বহু ধর্মাবলম্বী মানুষ এ অঞ্চলের দেশসমূহে বসবাস করে। রাষ্ট্র ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও বহু ধর্ম গোত্রের মানুষের বসবাস একত্রে হয়ে আসছে। ধর্মের কারণে মানুষকে ভাগ করা যায় না। সব মানুষই মহান সৃষ্টিকর্তার সবশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে। সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন, সেকথা সকল ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন। সব ধর্ম গোত্রের কাছে জীবন পরিচালনার জন্য গাইড লাইন রয়েছে। কোন ধর্মকে ছোট করে দেখার বিষয় নয়। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার একথা চির সত্য। এর বাইরে সমাজ বা রাষ্ট্র চলতে পারে না।
সাগরে যেমন বহু ধরনের প্রাণীর বিচরণ, একইভাবে রাষ্ট্রে বহুধর্মের মানুষের বসবাস। একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সব ধর্ম গোত্রের মানুষের বহুদলীয় জোটের মাধ্যমে। মানুষের কল্যাণ, উপকার, স্বার্থ, মানবীয় সব ধরনের অধিকার রক্ষা করা নিজ নিজ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ধর্মীয় মানুষের সংখ্যাধিক্য আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে কোনো প্রকারের বিভাজন সৃষ্টি আদর্শিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। রাষ্ট্রের কাজ হলো সব ধরনের গোত্র ধর্ম মানবতার কল্যাণে কাজ করা। এক গোত্রকে আরেক গোত্রকে অগ্রাধিকার প্রদান করা সমুচিত নয়। রাষ্ট্রের অধীনে সব মানুষ সব ধরনের নাগরিক সুযোগ সুবিধা সমানভাবে ভোগ করবে সেটাই আধুনিক রাষ্ট্রীয় সমাজের দায়িত্ব। আমাদের এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের দেখতে পাচ্ছি ধর্মের কারণে সমাজে মহল্লায় এলাকায় এলাকায় বিভাজন হৈ হাঙ্গামা বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বড় রাষ্ট্র। এখানে বহু ধর্মের মানুষের একত্রে বসবাস। বিভিন্ন রাজ্য রয়েছে তাদের দেশে। এসব রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম অপরাপর ধর্মাবলম্বী বসবাস করে আসছে। অন্যান্য ধর্মের সাথে ভারতের হিন্দুদের উল্লেখযোগ্য বাকবিতন্ডা না থাকলেও কিন্তু প্রায় সময় মুসলমানদের হিন্দুদের ঝগড়া ফ্যাসাদ, মারামারি, জ্বালাও-পোড়াও মুসলিমদের বস্তুচ্যুত করার ঘটনা হরহামেশা সংবাদ মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।
মুসলমানদেরকে কোনভাবেই ভারতের হিন্দু জনগণ বরদাস্ত করছে না। বিভিন্ন রাজ্যের মুসলামনদের জানমালের ওপর অত্যাচার অব্যাহত আছে। সেদেশের মুসলমানরা সরকারি চাকরি থেকে বলতে গেলে একেবারেই বঞ্চিত। চিকিৎসাসহ মানবিক অধিকার থেকেও মুসলিমরা বঞ্চিত হচ্ছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে সর্বদাই রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধার সম্মুখীন হয়। ঈদ উদযাপনে এবং কুরবানির পশু কুরবানি দেওয়ার মহান ইবাদতকেও সেদেশের সরকার বাধা প্রদান করার সংবাদ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। পার্শ্ববর্তী আরেক দেশ মায়ানমারে শত বছরের স্থায়ী বাসিন্দা মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে সেদেশের সেনা সরকার নির্মমভাবে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে তাদেরকে বস্তুচ্যুত করে চরমভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতিত নর-নারী বাংলাদেশে বসবাস করছে। তারা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার কারণে হয়েছে। তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন একমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে।
একইভাবে চীনে উইঘুর প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম জনগণের ওপর চীনা সরকার নানাভাবে নির্যাতন অত্যাচার চালাচ্ছে। তাদেরকে ইসলামের ধর্ম অনুশীলন অনুকরণের বাধা প্রদান করছে। এভাবে পৃথিবীর আরও বহু দেশে শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালাচ্ছে সেদেশের সরকার। অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আমরা নিরীহ শান্তিপ্রিয় মুসলিম জনগণ লক্ষ করছি যে, ভারত সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সেদেশের মুসলমানদের নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আসছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত মুসলমানদেরকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় বাধা দিচ্ছে। তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করছে। চাকরি থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করছে। সঠিকভাবে জীবন যাপনে তাদের কোনো প্রকারের সহযোগিতা ভারত সরকার করছে না। বর্তমান ভারতীয় সরকার সেদেশের বিভিন্ন রাজ্যে মসজিদ-মন্দির ইস্যু তৈরি করে দাঙ্গা হাঙ্গামা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো অঞ্চলে নিরহ মুসলমানদের রক্ত ঝরছে। এসবের কোনো প্রতিকার বিচার সেদেশের মুসলমানরা পাচ্ছে না। মসজিদ ভেঙে মন্দির করার দাবি তুলছে। মুসলমানদের মসজিদের এরিয়ায় হিন্দুদের মন্দিরের দাবি তুলছে। অযৌক্তিক অহেতুক অযাচিতভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতজুড়ে মুসলমান ইসলাম, মসজিদ নিয়ে নানাবিতর্ক দুনিয়াবাসী দেখতে পাচ্ছে। ইতিমধ্যে ভারতের শাসক দলের দুইজন নেতানেত্রী ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করেছে এবং সেটি সম্পূর্ণভাবে ভারত সরকারের ছত্রছায়ায় ইন্ধনে করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে চরমভাবে উত্তেজনা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে এ ঘটনার পর থেকে মুসলমানরা রাস্তায় নেমে পড়েছে, প্রতিবাদ করছে, মিছিল করছে, আন্দোলন করছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সমস্ত ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবই আবুদাবী, সৌদি আরব, কুয়েত, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া ইতিমধ্যে ভারতীয় হিন্দু-নাগরিকদের তাদের দেশ হতে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের সেদেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে ডেকে কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে। এভাবে মুসলিম দুনিয়ায় নবী মুহাম্মদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্ব আগুনে জ্বলছে।
মূলত মুসলমানদের নিকট সবচেয়ে অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় হলো হযরত মুহাম্মদ (সা.)। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে একজন মুসলমান তার জীবন, সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি এক কথায় সমস্ত কিছুর ওপর নবী মুহাম্মদকে ভালবাসায় হলো ঈমানের অন্যতম অঙ্গ। তাই মুসলমানরা কোনোভাবেই ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কোনো ধরনের আঘাত আসলে সেটা সহ্য করতে পারে না। সহ্য করে বসে থাকা কোনো মুসলমানের ঈমানের লক্ষণ হতে পারে না। অবশ্যই মুসলমানরা যার যার অবস্থান, প্লাটফরম, প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের কাজের নিন্দা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করা সাধ্যমতো ঈমানের দাবি। এখানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো কথা নেই। ধর্মের জায়গায় সমস্ত মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নবীর মান-সম্মান ইজ্জত আব্রু রক্ষা করা সব মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব ঈমানী কর্তব্য। ইসলাম এবং নবীর চরিত্র রক্ষা করা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। ইসলামের নবীর ওপর কোনো ধরনের আঘাত আসলে সেটা কোনো মুসলমান চোখ বুজে বন্ধ করে থাকতে পারে না। সেটায় ঈমান সেটায় মুসলমানের ধর্ম। বিশ্বের যেকোন অঞ্চলে মুসলমানরা ধর্ম, ইসলাম, নবী-রসুল ইসলামের আদর্শ পালনে বাধা সম্মুখীন হলে সেজন্য মুসলমানদেরকে আপনাপন অবস্থান থেকে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে।
মুসলমানরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের নাম। ইসলামে যারা বিশ্বাস করবে তাদেরকে অবশ্যই ইসলামের সমস্ত নিয়মনীতি বিশ্বাস করতে হবে। অনুসরণ অনুকরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। পৃথিবীর মধ্যে ইসলামে যেভাবে একজন মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য দিক নির্দেশনা রয়েছে, সেভাবে অপরাপর অন্য ধর্মে ইসলামের মতো পরিপূর্ণ কোনো বিধান দেয়া হয়নাই। তাই ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়। সুতরাং ইসলাম ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের আদর্শিক বহু দূরত্ব রয়েছে। সেটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম শাশ্বত জীবন বিধান। আপন গতিতেই ইসলাম থাকবে এবং আছে। পৃথিবী যতদিন থাকবে ইসলামের বিধান অপরিবর্তীতভাবে পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকবে। মুসলমানরা ইসলামের আদর্শ নিয়ে কথা বলে। নবীর সুন্নাহ আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলে। কারণ ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। পবিত্র কুরআন শরীফ এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ পবিত্র হাদীস শরীফ মানব জাতির পথচলার জন্য চিরঞ্জীব পথেয়। সুতরাং ইসলামের অনুসারী মুসলমানরা কেয়ামত পর্যন্ত এ আদর্শের কথা বলতেই থাকবে। বলাটাই তাদের ওপর অবশ্যই কর্তব্য। এ অঞ্চলে যারা ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের মধ্যে হানাহানী সৃষ্টি করছে ইসলাম সেটা পছন্দ ও সহ্য করে না। সে ধরনের মানবতা বিরোধী কোনো আচার-আচরণ হাঙ্গামা বিশৃঙ্খলা ইসলাম কোনোদিনই অনুমোদন দেয়নি। মুসলিম বিশ্বে তার প্রমাণ হচ্ছে যে, মুসলমানদের নিকট সব ধরনের অমুসলিমরা আবহমান কাল থেকে নিরাপদে বসবাস করে আসছে। মুসলমানদের কারণে বিশ্বের কোথাও অপর ধর্মের লোকেরা তাদের জীবন পরিচালনায় বাধার সম্মুখীন হয়নি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে তাদেরকে কোনো প্রকারের বাধা দেয়নি মুসলিম দুনিয়া। তাই অসাম্প্রদায়িক এবং শান্তিপ্রিয় বিশ্বের এক নম্বর মানুষ হলো মুসলিম জাতি। ইসলামের নবীর ওপর আঘাত করে কোনোভাবেই অন্য কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষী যেসব আচরণ লক্ষ করছি তার নিন্দা জানাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। সাগর যেমনিভাবে তার সমস্ত প্রাণীদের আগলে রেখে নিজ গতিতে চলছে, অনুরূপভাবে ভারতকেও বলব সেদেশের সব ধর্ম গোত্র মানুষের প্রতি ন্যায়নীতি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেদেশ যেন সেদেশের সরকার পরিচালনা।