রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে
সাম্প্রতিক সময়ে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’এর চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দেশ বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউমান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুষ্টু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে ১১লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে আসছেন। মাস্টার মুহিবুল্লাহকে কেন হত্যা করা হল? কারা হত্যা করতে পারে? উদ্দেশ্য কী? এর আগেও আরও দু’জন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়। অপরাধী ধরা পড়েনি বা শাস্তি হয়নি। এছাড়া অস্ত্র বেচাকেনা, মাদকব্যবসা, ডাকাতি, নারীপাচার, আধিপত্যবিস্তারের লড়াই, হ্নীলা ও টেকনাফের গহিন জঙ্গলে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেলে হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী এ পর্যন্ত ২২৬ জনের বেশি রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ছাড়া মাদক ও অস্ত্রবহনের দায়ে দু’হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে এক হাজার ২৯৮টি মামলা দায়ের করা হয়।
ক্যাম্পগুলোর বাইরে-ভেতরে সর্বদা আতঙ্ক ও উৎকন্ঠায় জীবন কাটছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের। নেতাদের (মাঝি) নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে রয়েছে ভীতি ও শঙ্কা। আগামীতেও সহিংসতা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটবে না, এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে মিয়ানমার থেকে অস্ত্র আসছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে সীমান্তে মাদক ও অস্ত্র চোরাকারবারীদের গুলি করা হবে। রাজনীতি ও সমাজবিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারকে এ মুহূর্তে সিরিয়াস পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বর্ডার সীল করে দিতে হবে। অভিযান পরিচালনা ও নিরাপত্তা জোরদার করে ক্যাম্পগুলোকে সন্ত্রাসীমুক্ত করতে হবে। এর আগে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করা অত্যন্ত জরুরি।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা এতটাই ঠুনকো যে, ঘাতকরা সেখানে ঢুকে, ঠাণ্ডা মাথায় রোহিঙ্গানেতা মুহিবুল্লাহকে পাঁচটি গুলি চালিয়ে হত্যা করে এবং সহজেই সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা এতটা বেপরোয়া ছিল মুখে মাস্ক পড়ারও গরজ অনুভব করেনি। নিহত মুহিবুল্লাহর অনুজ থানায় যে মামলাটি করেন সেখানে কোন আসামির নাম পর্যন্ত উল্লেখ করার সাহস করেননি; কেবল লিখেছেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। এতেই অপরাধীচক্রের শক্তি ও দাপটের আঁচ করা যায়। বেশ কিছু দিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মুহিবুল্লাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। উল্লেখ্য যে, মাস্টার মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের আরাকানে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এ দাবি তিনি জেনেভা ও ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেন। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘আমরা (রোহিঙ্গারা) দ্রুতত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাই।’
শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা ও হত্যা জিইয়ে রাখতে পারলে বর্মীজান্তার জন্য বহিঃর্বিশ্বে প্রপাগান্ডা চালিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার সুযোগ হাতে আসবে। এছাড়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ করার বা নেতৃত্ব দেওয়ার মত যোগ্যতাসম্পন্ন কোন নেতা যদি মাথা তোলে, তাকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে মিয়ানমার সরকারের। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বশুন্য করা। ক্যাম্পে বসবাসকারিদের সাথে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে। আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের তদন্ত কমিটির কাছে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের তথ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এতে মিয়ানমার সরকারকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
পাঁচ বা দশ শতাংশ অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও বাকি রোহিঙ্গারা নিরপরাধ, শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ। ১৫টির মত সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয়। ক্যাম্পগুলোর চারদিকে কাঁটাতারের বেষ্টনি থাকলেও ফাঁক ফোকর দিয়ে যে কেউ রাতের বেলা ঢুকতে পারে এবং বের হতে পারে। সিসি ক্যামেরার পরিধি সম্প্রসারণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারি বাড়ালে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্যাম্পের বাইরে-ভেতরে শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা গেলে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া এত বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর কার্যকর মনিটরিং অসম্ভব। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহসহ আরও যেসব নেতা নিহত হয়েছেন এর পেছনে কাদের হাত সক্রিয় তা বের করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন