ফাতিমা আল-ফিহরি: এক মহীয়সী নারীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
খোবাইব হামদান
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)
একটি দেশের নাগরিক সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই হিসাবে এই প্রশ্ন সবার জাগতে পারে? বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি? নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে যার অস্তিত্ব এখন আর নাই। তাই কথা কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের যেতে হবে মধ্যযুগে। একটা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে মধ্যযুগ বলতেই বর্বরদশা হলেও ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। তাঁরা ইউরোপীয় রেনেসাঁসে প্রভাবিত বলে দাবি করলেও তাদের বোধশক্তি দিয়ে এটা বিবেচনা করতে পারেনি যে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের উত্থান কোথায়? মধ্যযুগের সোনালি অধ্যায়ে ইবনে হাইসাম, আল-রাজি, ইবনে সিনা, ইবনে বাতুতা, ভুগোলবিদ আল-মাসুদি, আল-বেরুনি, আল-বাত্তানী, আল-ইদরীসী এবং আল-খাওয়ারিজমি সহ এমন অনেক জ্ঞানবোদ্ধাদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে ইউরোপীয় রেনেসাঁস, যারা মধ্যযুগের বুকে বসে খুলেছে জ্ঞানবিজ্ঞানের দরজা। বাগদাদ, আন্দালুস এবং কায়রোর বুকে মধ্যযুগে মুসলিম গবেষকদের যে অগ্রগতি ছিল তা আজো অব্যাহত থাকলে পরশ্রীকাতর ইতিহাসবিদদের হাতেও উঠাতে হতো ভিন্ন কলম। পৃথিবীর চিত্র হতো এখন থেকে আরও কয়েকগুণ উন্নত এবং ভিন্নরকম। কিন্তু সেই অগ্রগতির ওপর মোঙ্গলদের থাবা এবং পরষ্পরের হিংসুটে মনোভাব এসে যে তাণ্ডব চালিয়েছে বাগদাদ কেন! মুসলিম বিশ্বের আর কোন শহর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সেই গতি নিয়ে আর দাঁড়াতে পারেনি। ইউরোপীয় সভ্যতাকে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় মধ্যযুগীয় বাগদাদ ও আন্দালুসের সোনালি অধ্যায় থেকেই তাদের পাঠ শুরু।
সেই মধ্যযুগীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের সোনালি যুগে আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার কারউইনে জন্ম নেয় এক মুসলিম মহীয়সী নারী যার নাম ছিল ফাতিমা আল-ফিহরি। তার বাবা মুহাম্মদ আল-ফিহরি ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ফাতিমা আল-ফিহরি ও তার পরিবার আফ্রিকার রাজধানী কারউইন থেকে বৃহত্তর মরক্কো ইদরীসিয়ার রাজধানী ফেজ শহরে হিজরত করেন। ফাতিমার পিতা মুহাম্মদ আল-ফিহরি মহাবিদদের মধ্যে একজন, তিনি নারীশিক্ষা নিয়ে ছিলেন বেশ সজাগ, দুই মেয়ে ফাতিমা ও মরিয়মকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তার মৃত্যুর পর ফাতিমা ও মরিয়ম দুই বোন উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের পিতার অঢেল সম্পদের মালিক হোন। তখন দুজনেই ইচ্ছেপোষণ করে মসজিদ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার।
২৪৫ হিজরির রমজান মাসে ফাতিমা গড়ে তোলে মরক্কোর উত্তরাঞ্চলের ফেজ শহরে একটি মসজিদ। বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকায় মসজিদের অলংকরণ হয় অভূতপূর্ব উদাহরণ। ঐতিহাসিকদের মতে এই মসজিদই পরবর্তীতে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপলাভ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার ওপর উচ্চতর পাঠদান করা হতো। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, কারাউইনের জামে মসজিদ মরক্কোতে ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে সুদীর্ঘকাল। এরপর এই নেতৃত্বে জ্ঞানের বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে সুদূর ইউরোপেও।
ইউনেস্কো, গিনেস বুক এবং অনেক স্কলারের মতানুযায়ী আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যা সগৌরবে পৃথিবীর বুকে আজও জ্ঞানের প্রসার ঘটাচ্ছে। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আল-কারাউইন তার নিজের গতিতে চলে বিস্তার করছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। ১৯৬৩ সালে মরক্কোর সরকার এ বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিকেও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ রয়েছে। একবার আগুনে পুড়ে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও এখনো প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে। এর মধ্যে আছে নবম শতকে লেখা একটি কুরআন শরিফ, হাদীসের সংকলন, ইমাম মালিকের গ্রন্থ মুয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের লেখা রাসুল ঊ-এর জীবনী, ইবনে খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার এবং আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপিসহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ।
ফাতিমার প্রতিষ্ঠিত কারাউইন মসজিদ এবং কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে ফেজ হয়ে উঠতে থাকে আফ্রিকার ইসলামী শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। শুধু মুসলমান নয়, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি এবং খ্রিস্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। এর ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার। যিনি এখান থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করে সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দেরকে প্রথম শূন্যের ধারণার সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত মালিকি বিচারপতি কাজী আবু বকর ইবনে আল-আরাবি, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এবং জ্যোতির্বিদ নূরুদ্দীন আল-বিতরুজি। এখান থেকে আল-ইদরীসীর মানচিত্র নিয়ে রেনেসাঁসের সময় কাজ করেছিল ইউরোপীয়ানরা। (সূত্র: ফিচার, ডেইলি বাংলাদেশ)
মুসলিম এই মহীয়সী নারী ফাতিমা আল-ফিহরি ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। উনার জন্মে জন্মেছিল বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যা আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে এখনো হাজার-হাজার শিক্ষার্থী জ্ঞানলাভ করে বের হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী: জামিয়া মোজাহেরুল উলুম চট্টগ্রাম