বিপদ-মুসিবত উত্তরণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)–এর নীতি ও আদর্শ
ফাতেমা-তুজ-জাহরা
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)
উপক্রমনিকা:
আমাদের জীবনটা বড্ড সমস্যা সংকুল। এই জীবন কখনো যদি আমাদের সামনে বিপদ-মুসিবতের ঢালি নিয়ে হাজির হয়, তখনি আমরা ভেঙে পড়ি। ভেতরে ভেতরে গুড়িয়ে যাই। অথচ জীবনটা তো এমনই। বহতা নদীর স্রোতের মতো জীবনের গতিপথ সরল এবং সোজা নয়; বরং তা হলো দুর্গম, বন্ধুর এবং কন্টাকাকীর্ণ।
তাই মুমিন ব্যক্তি মাত্রই বিশ্বাস করে যে, যত সংকটই আসুক না কেন, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। ফলে সে বিপদ-মুসিবতে পড়েও ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করে না। বরং নিজের ভাষা ও আচরণ সংযত রাখে। কারণ সে আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী। সে বিশ্বাস করে যে, মুমিনের জন্য বিপদ-মুসিবত নিয়ামতস্বরূপ। কারণ এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়। বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট থেকে নিঃসন্দেহে যথাযথ ও উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়া যায়। তাই মুমিন বিপদ-মুসিবতে পড়লে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি কান্নাকাটি করে। আল্লাহর কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে। সৃষ্ট জীব থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর দিকেই ফিরে আসে। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত মু‘মিনের যথাযথ পরিচয়।
বিপদ-মুসিবতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ:
বিপদ বা মুসিবত শব্দের আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে আরবি অভিধান বেত্তাগণ একবচনে বহুবিদ শব্দের ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে خطر، مصيبة، آفة، مشكلة، نازلة، محنة، عاهة، شديد ইত্যাদি।[1] যাদের বহুবচন হচ্ছে যথাক্রমে اخطر، مصائب، آفات، مشاكل، نوازل، محن، عاهات، شدائد।[2]
বিপদ বা মুসিবত শব্দের অর্থ সম্পর্কে আরবি অভিধানে বলা হয়েছে,
البلاء معناه في اللغة المصيبة والمحنة وفي الاصطلاح التي تنزل بالمرء ليختبر بها.
‘বান্দার ওপর আপতিত বিবিধ বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট যা দ্বারা বান্দাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।’[3]
মূলত বান্দার ঈমানের দৃঢ়তা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপর অটুট ও অবিচল তাওয়াক্কুল পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্যই এসব বিপদ-আপদ-বালা-মুসিবতের আবর্তন ঘটে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক সৃষ্ট এ মানবজাতি ‘আশরাফুল মাখলুকাত তথা সর্বশ্রেষ্ঠসৃষ্টি অভিধায় বিভূষিত। এ মানব জীবনের প্রারম্ভ থেকে মৃত্যু অবধি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আল্লাহর প্রিয় ভাজন তথা নবী-রাসূল, আউলিয়ায়ে কামিলীন, মুসলিম-মুমিনের জীবনে, যুগ-যুগান্তরে, কাল-কালান্তরে, দেশ-দেশান্তরে অসংখ্য বিপদ-মুসিবতের ঢালি নিয়ে হাজির হয়েছে। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে এসব বিপদ-মুসিবত থেকে উত্তরণে অত্যন্ত প্রাণজ্জ্বল ও সহজবোধ্য ভাষায় বিধৃত হওয়া কুরআন-সুন্নাহর সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা ও আদেশ-উপদেশাবলি, নীতিমালা অনুসরণ করাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এরনীতি ও আদর্শ হিসেবে তাঁদের কাছে বিবেচিত হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহয় বালা-মুসিবতের বেশ কিছু পরিভাষা আমরা দেখতে পাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিভাষাগুলো হলো:
1. مصيبة |
2. بلاء |
3. سر |
4. ضر |
5. بأس |
6. شدة |
যেমন কুরআন বর্ণিত আছে,
وَبَشِّرِ الصّٰبِرِيْنَۙ۰۰۱۵۵ الَّذِيْنَ اِذَاۤ اَصَابَتْهُمْ مُّصِيْبَةٌ١ۙ قَالُوْۤا اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَيْهِ رٰجِعُوْنَؕ۰۰۱۵۶
‘আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করুন, যাদেরকে কোনো বিপদ আক্রান্ত করলে তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্যই, তাঁর কাছেই তো আমরা ফিরে যাব।”[4]
আল-কুরআনের অন্যত্র আছে,
وَالصّٰبِرِيْنَ فِي الْبَاْسَآءِ وَالضَّرَّآءِ وَ حِيْنَ الْبَاْسِ١ؕ اُولٰٓىِٕكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا١ؕ وَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ۰۰۱۷۷
‘যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট, দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।’[5]
বিপদ-মুসিবত উত্তরণে কুরআন–সুন্নাহর আলোকে রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর অনুসৃত নীতি ও আদর্শ:
এটি সর্বজন স্বীকৃত ও বিধিত যে, আমাদের প্রাণপ্রিয় জীবনব্যবস্থা আল-ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা (Complete Code of Life)। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মানবজীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত অজস্র সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ। উপরন্তু এ ধর্মের প্রবক্তা রাসূলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর পবিত্র চরিত্র শোভাই সকল সমস্যার সমাধানের অন্যতম নিয়ামক যার কোনো বিকল্প নেই। উম্মাহাতুল মুমিনিন হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রাদি:)-কে রাসূলে মাকবূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর পবিত্র চরিত্র শোভা সম্পর্কে জনৈক সাহাবা (রাদি:) কর্তৃক জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তাৎক্ষণিক যাওয়াব প্রদান করলেন, خلقه القرآن অর্থাৎ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনই হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর পবিত্র চরিত্র শোভা (Unique Character)। উপর্যুক্ত হাদিসে মুবারাকা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল-কুরআন (وحي متلوا) ও আল-হাদীস (وحي غير متلوا) এ দ্বিবিধ অনুষঙ্গই আমাদের জীবনের সকল সমস্যা তথা বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত, দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা ইত্যাদি থেকে উত্তরণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর নীতি ও আদর্শ যা প্রতিটি মুসলিম-মুমিনের একনিষ্ঠ অনুসরণ-অনুকরণ করা অতীব বাঞ্চনীয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের মাঝে হযরত আইয়ুব (আলাইহিচ্ছালাম)-এর পবিত্র জীবন থেকে দৃষ্টান্তস্বরূপ পবিত্র কুরআন করীমে এসেছে,
وَاَيُّوْبَ اِذْ نَادٰى رَبَّهٗۤ اَنِّيْ مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَاَنْتَ اَرْحَمُ الرّٰحِمِيْنَۚۖ۰۰۸۳
‘স্মরণ করো আইয়ুব (আলাইহিচ্ছালাম)-এর কথা, যখন তিনি তাঁর প্রতিপালককে ডেকেছিল, (এই বলে যে) আমি দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়েছি, আপনি তো দয়ালুদের সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’[6]
হযরত আইয়ুব (আলাইহিচ্ছালাম)-এর উপর্যুক্ত প্রার্থনা থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, অর্থাৎ আমার এ দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত ইত্যাদি উত্তরণে আপনি খালিক-মালিকই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল আমি এ ব্যাপারে আর কারো কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ার প্রত্যাশী নই।
বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর নীতি ও আদর্শ। আর রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) হচ্ছেন, خلقه القرآن বা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনই হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর পবিত্র চরিত্র শোভা (Unique Character)-এর প্রতিচ্ছবি।তাই মুসলিম-মুমিনের আদর্শ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর অনুসৃত আদর্শই একনিষ্ঠ আদর্শ হওয়া বাঞ্চনীয়। কুরআনে করীমে ইরশাদ হয়েছে,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوةِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ۰۰۱۵۳
‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর বারেগাহে) সাহায্য চাও। নিশ্চয়; আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।’[7]
আর বিপদগ্রস্থ হয়ে যারাই ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা করেছে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই কালক্রমে সমূহ বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত থেকে তাঁর অপার করুণায় মুক্তি দিয়েছেন।
কুরআনে করীমের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا١۫ وَاتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَؒ۰۰۲۰۰
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থেক এবং (তোমাদের কুপ্রবৃত্তির) পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’[8]
আর আল্লাহকে ভয় করলে সফলতা সুনিশ্চিত। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। ইনশাআল্লাহ।
হাদিস শরীফে এসেছে সালাতে দুই সিজদার মাঝখানে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) বিপদ-আপদ-বালা-মুসিবতসহ সর্বপ্রকার কাঠিন্যতা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করতেন,
«رَبِّ اغْفِرْ لِيْ، وَارْحَمْنِيْ، وَاجْبُرْنِيْ، وَارْزُقْنِيْ، وَارْفَعْنِيْ».
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মাফ করে দিন, আপনি আমার ওপর রহম করুন, আপনি আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আপনি আমার জীবনের সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি পুরণ করে দিন, আপনি আমাকে নিরাপত্তা দান করুন, আপনি আমাকে রিযিক দান করুন এবং আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিন।’[9]
উপর্যুক্ত দোয়া দ্বারা আমরা প্রতি ওয়াক্ত নামাযের প্রতি রাকাতে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনাকরার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর নীতি-আদর্শের অনুসরণ-অনুকরণে আল্লাহর অপার করুণায় তাঁর রাহমাত-মাগফিরাত-দয়াসহ বিপদ-আপদ-বালা-মুসিবত-রোগ-শোক-দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করতে পারি।
বিপদ-মুসিবতে পতিত কোনো ব্যক্তিকে দেখলে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে নসিহত করেছেন,
الْـحَمْدُ للهِ الَّذِيْ عَافَانِيْ مِمَّا ابْتَلَاكَ بِهِ، وَفَضَّلَنِيْ عَلَىٰ كَثِيْرٍ مِمَّنْ خَلَقَ تَفْضِيْلًا.
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে সেই মসীবত থেকে নিরাপদ রেখেছেন, যার মধ্যে তিনি তোমাকে পতিত করেছেন এবং আমাকে মর্যাদা দান করেছেন অনেক সৃষ্টি জগত থেকে।’[10]
অনুরূপভাবে খারাপ দিন-রাত, মন্দ সময়, খারাপ সঙ্গী ও প্রতিবেশি থেকে পরিত্রানের জন্য আল্লাহর রাসূল ঊ নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে নসিহত করেছেন,
اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ يَوْمِ السَّوْءِ، وَمِنْ لَيْلَةِ السَّوْءِ، وَمِنْ سَاعَةِ السَّوْءِ، وَمِنْ صَاحِبِ السَّوْءِ، وَمِنْ جَارِ السَّوْءِ فِي دَارِ الْـمُقَامَةِ.
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট খারাপ দিন-রাত, মন্দ সময়, মন্দ সঙ্গী ও খারাপ প্রতিবেশি থেকে পানাহ চাচ্ছি।’[11]
হৃদয়ের গভীরে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, ভালোমন্দ সবকিছুই আল্লাহর হাতে। মানুষের হৃদয় তারই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। তিনি চাইলে এ হৃদয়কে ঈমানের আলোয় আলোকিত করতে পারেন, আবার কুফরের অন্ধকারেও নিমজ্জিত করতে পারেন। কাজেই আলোর জন্য প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়াই সচেতন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর দেখানো এবং শিখানো রীতি-আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণের মাধ্যমে আমরা প্রতি নিয়ত আমাদের জীবনকে আল্লাহর অশেষঅনুকম্পায় পরিপূর্ণ করে নিতে পারি।
বস্তুত মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে যেসকল গুনাহ বা অপরাধ করে সেগুলোই মূলত তার জন্য বিপদ-মুসিবত ও রোগশোক বয়ে আনে। অপরদিকে মহান আল্লাহর নিঃশর্ত আনুগত্য মানুষের জীবনে প্রকৃত মুক্তি, আরোগ্য ও আনন্দ বয়ে আনে এই দৃষ্টিকোণ থেকে পাপীরা সুস্থ ও সম্পদশালী হলেও তারই মূলত বিপদগ্রস্থ। পক্ষান্তরে সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত হলেও তারাই মূলত বিপদমুক্ত।
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّالَّذِيْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَؒ۰۰۱۲۸
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল।’[12]
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
وَاِنَّ اللّٰهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَؒ۰۰۶۹
‘নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন।’[13]
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুষ্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, আল্লাহর প্রতি তাকওয়া, সৎকর্ম, দোয়া, সালাত, ধৈর্য্যই হচ্ছে বিপদ উত্তরণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর নীতি ও আদর্শ। আর ধৈর্যশীলদের পুরষ্কার তিনগুণ (নেয়ামত, রহমত ও হেদায়ত) পবিত্র কুরআন করীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَبَشِّرِ الصّٰبِرِيْنَۙ۰۰۱۵۵ الَّذِيْنَ اِذَاۤ اَصَابَتْهُمْ مُّصِيْبَةٌ١ۙ قَالُوْۤا اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَيْهِ رٰجِعُوْنَؕ۰۰۱۵۶ اُولٰٓىِٕكَ عَلَيْهِمْ صَلَوٰتٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ١۫ وَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُهْتَدُوْنَ۰۰۱۵۷
‘আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করুন; যাদেরকে কোনো বিপদ আক্রান্ত করলে তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্যই, তার কাছেই তো আমরা ফিরে যাব। এদের প্রতি রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অনুগ্রহ ও করুনা আর এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’[14]
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) বলেছেন,
«وَاعْلَمْ أَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ».
‘জেনে রাখো, সবরের সাথেই সাহায্য রয়েছে।’[15]
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের সমুদয় ভালো কাজ আল্লাহর একটি মাত্র অনুগ্রহেরই মূল্যপরিশোধ করতে পারবেনা। কারণ, আল্লাহর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নিয়ামত ও অনুগ্রহও মানুষের সমুদয় সৎকাজের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ও জস্বী। সুতরাং আমাদের প্রতি আল্লাহর যে অধিকার রয়েছে, তার প্রতি সব সময় সজাগ ও যত্নশীল থাকা উচিত। হযরত শাকীক বলখী (রহি:) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট বিপদাপদের অভিযোগ করবে, সে কখনো তার অন্তরে আল্লাহর আনুগত্যের স্বাদ পাবেন। বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মুসিবতে কাপড় ছেঁড়া, বুক ও কপাল চাপড়ানো, হাত থাপড়ানো, চুল কামানো, এমনকি ধ্বংসের জন্য দু‘আ করা ইত্যাদি মূলত: অধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ বিধায় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি ঘোষণা করেছেন। তাই আমাদেরকে সর্বদা-সর্বাবস্থায় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) কর্তৃক প্রদর্শিত রীতি-আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণের মাধ্যমে বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত, দুঃখ-দুর্দশা উত্তরণের শিক্ষা নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর শিক্ষা আমল করার তাওফীক দিন। আমিন, বিহুরমাতি সাইয়িদিল মুরসালীন।
[1] সম্পাদনা পরিষদ, বাংলা-আরবি অভিধান, (ঢাকা: ইফাবা, জুন ২০১৫ খ্রি.), পৃ. ৭৪১
[2] প্রাগুক্ত
[3] ড. ইবরাহীম মাদকূর, আল-মু’জামুল ওয়াসীত, (দেওবন্দ: জাকারিয়া বুক ডিপো, সাহরানপুর, প্রথম সংস্করণ, ২০ আগস্ট ২০০১ খ্রি.), পৃ. ৭১
[4] আল-কুরআন, সূরা: ২ (আল-বাকারা): ১৫৫-১৫৬
[5] আল-কুরআন, সূরা: ২ (আল-বাকারা): 177
[6] আল-কুরআন, সূরা: ২১ (আল-আম্বিয়া): ৮৩
[7] আল-কুরআন, সূরা: ২ (আল-বাকারা): ১৫৩
[8] আল-কুরআন, সূরা: ৩ (আলে ইমরান): ২০০
[9] আবূ দাউদ, ১/১২১, হাদীস: ৮৫০; তিরমীযী: ২৮৪ ও ২৮৫; ইবনে মাজাহ: ৮৯৮
[10] হিসনে হাসীন, পৃ. ৩০৭
[11] হিসনে হাসীন, পৃ. ৩০৭
[12] আল-কুরআন, সূরা: 16 (আন-নাহল): ১২৮
[13] আল-কুরআন, সূরা: 29 (আল-আনকাবূত): ৬৯
[14] আল-কুরআন, সূরা: ২ (আল-বাকারা): ১৫৫-১৫৭
[15] (ক) ইবন আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ. ৩১৫; (খ) তাবরানী, আল-মু’জামুল কবীর, ১১২৪৩