[এটি হযরতজি মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.)-এর জীবনের সর্বশেষ গুরুত্ত্বপূর্ণ বয়ান, যা তিনি মৃত্যুর তিন দিন আগে ২৬শে যুলকাদাহ, ৩০শে মার্চ, মঙ্গলবার দিন বাদে ফজর লাহোরের রায়ব্যান্ডে পেশ করেছিলেন।
মাওলানা মুহাম্মদ মানযুর নুমানী ও মাওলানা আতিকুর রহমান সম্ভলী (রহ.) সংকলিত‚ তাযকেরায়ে হযরতজি মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.)[1] কিতাব থেকে এর অনুবাদ পেশ করছি, আশা করি আল্লাহর মেহেরবানিতে ফিতনার এই ভারি বর্ষায় উম্মাহর দরদি দায়ীদের জখমী দিলে স্বস্তির অনুভূতি ফিরিয়ে আনবে।]
মূল: হযরতজি মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.)
অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল আলিম
হামদ ও সালাতের পর
‘দেখো, আমার মেজাজ ঠিক নেই, সারা রাত ঘুম আসেনি। এরপরও জরুরি মনে করে বলছি, যে বুঝে আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে চমকিয়ে দেবেন, অন্যথায় সে নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মারবে।’
‘অনেক কষ্টের বদৌলতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য গড়ে উঠেছিল। নবীজি (সা.)ও তাঁর সাহাবারা এক উম্মাহর অস্তিত্ব নির্মাণে বহু কষ্ট শিকার করেছিলেন। মুসলমানদের চির দুশমন ইহুদি-খ্রিস্টানরা মুসলিমরা যেন বিভক্ত হয়ে এক উম্মাহর অবয়বে না থাকে, এ তৎপরতায় সদা সচেষ্ট ছিল।
আজ মুসলমানরা নিজেদের উম্মতপনা (এক উম্মাহ হওয়ার বৈশিষ্ট্য) হারিয়ে ফেলল। যখন মুসলমানরা এক উম্মাহ ছিলেন, মাত্র কয়েক লাখ মুসলমানের মোকাবেলা গোটা পৃথিবীর জন্য ভারি কঠিন ছিল। তখন না ছিল কোনো পাকা ঘর, কোন পাকা মসজিদ, মসজিদে জ্বলেনি কোন আলোর চেরাগ। হিজরী নবমবর্ষে সর্বপ্রথম তামিমে দারী (রাযি.) মসজিদে নববীতে আলোর চেরাগ জ্বালান। তিনি নবম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তখন প্রায় সমগ্রআরব ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল। ভাষাভিন্ন, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী এক উম্মাহর রূপ ধারণ করেছিল। এক উম্মাহর অস্তিত্ব লাভের পরই মসজিদে নববীতে আলোর চেরাগ জ্বলেছিল। রাসূল (সা.) কর্তৃক আনিত হিদায়েতের নূর আরব অনারব সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছিল, সকলে এক উম্মাহতে পরিণত হয়েছিল। এরপর এই উম্মাহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই আত্মপ্রকাশ করেছিল সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য তাদের পদতলে এসে পড়েছিল। এভাবে এই উম্মাহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র কারণ এটিই ছিল যে, এদের কেউই নিজ জাতি-গোষ্ঠী, দেশ-দল, ও ভাষা-বর্ণের মদদদাতা ছিল না। ছিল না অর্থ-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্রের প্রতি তাদের কোন আসক্তি। বরং সকলের একটাই কামনা ছিল যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কী বলেন? উম্মাহ তো তখনই গড়বে যখন আল্লাহ ও রাসূলের মোকাবেলায় অন্য সব কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। উম্মাহর ঐক্যের যুগে কোথাও কোন একজন মুসলমানের হত্যার দরুন সকল মুসলমান নড়ে উঠতো। কিন্তু আজ হাজারও লক্ষ মুসলমানের গলা কাটা হচ্ছে তবুও এর প্রতি করা হয় না কর্ণপাত।’
‘উম্মাহ কোন জাতি-গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট জনপদবাসী নয়। উম্মাহ তৈরি হয় হাজারও কোটি জাতি-গোষ্ঠীর সম্মিলনে। যদি কেউ কেবল কোন জাতি বা অঞ্চলকে আপন মনে করলো অন্যদেরকে পর ভাবলো, সে উম্মাহকে খানখান করে যবেহ করলো। সে নবীজি (সা.) ও সাহাবাদের মেহনতের ওপর পানি ঢেলে দিল। আমরাই সর্বপ্রথম বিভক্ত হয়ে উম্মাহকে যবেহ করে দিয়েছি। ইহুদি–খ্রিস্টানরা তো এই খণ্ডিত উম্মাহকেই টুকরো করেছে। যদি আবারও মুসলমানরা উম্মাহর ঐক্য গড়ে তুলতে পারে তাহলে সকল শক্তি মিলে তাদের একটি চুলও বাঁকা করতে পারবে না। আ্যটম-রকেট তাদের ধ্বংস করতে পারবে না। আর যদি জাতীয় ও ভৌগলিক সাম্প্রদায়িকতার দরুন পরস্পর উম্মতকে বিভক্ত করতে থাকে, তাহলে আল্লাহর শপথ! তোমাদের হাতিয়ার, সৈন্য-সামন্ত কোন কিছুই তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না।’
‘বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা আজ এ জন্য মার খাচ্ছে আর মরছে যে, তারা উম্মাহকে ধ্বংস করে নবীজির কুরবানীর ওপর পানি ঢেলে দিয়েছে। এগুলো আমার দিলের দুঃখের কথা বলছি। সকল ধ্বংসের মূল কারণ আমরা আজ উম্মাহ রয়নি। বরং উম্মাহ কী? তাও ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি কিভাবে নবীজি উম্মাহর অস্তিত্ব নির্মাণ করেছিলেন। উম্মাহর ঐক্য গড়ার জন্য, মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ তায়ালার গায়বী মদদ লাভ করার জন্য শুধু নামায-দুয়া, যিকির-অযিফা, মাদরাসা-তালিম চালু থাকাই যথেষ্ট নয়।
হযরত আলী (রাযি.)-কে হত্যাকারী ইবনে মুলজিম এরকম নামাযী ও যাকের ছিল যে, লোকেরা তাকে হত্যা করার সময় গোস্বাভরে যখন তার জবান কাটতে উদ্ধত হলো, তখন সে বললো, তোমরা সব কিছু করো কিন্তু আমার জবান কেটো না, যাতে আমি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আল্লাহর যিকির করতে পারি। অথচ এর সম্পর্কেই নবীজি (সা.) বলেছিলেন, আলীর হত্যাকারী হবে আমার উম্মাতের সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি। মাদরাসার তালিম তো আবুল ফযল ফয়জীও হাসিল করে ছিল, এত্ত বেশি যে, নুকতাবিহীন কুরআনের তাফসির লিখেছিল। অথচ এই ফয়জীই সম্রাট আকবরকে গোমরাহ করে দীন ধ্বংস করেছিল।’
‘হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) ও হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.) এবং তাঁদের সাথীরা দীনদারির বিচারে সর্বোত্তম জামায়াত ছিলেন। তারা যখন সীমান্ত এলাকায় পৌঁছান, সেখানকার লোকেরা তাদেরকে নিজেদের মুরুব্বি মেনে নিলো। তখন শয়তান কিছু মুসলমানের অন্তরে এ কুমন্ত্রণা ঢেলে দিল যে, এরা ভিন্ন অঞ্চলের লোক, এদের কথা এখানে কেন মানা হবে? ফলে তারা তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটালো, অনেক সাথীকে শহীদ করা হলো। এভাবে স্বয়ং মুসলিমরাই ভৌগলিক সাম্প্রদায়িকতার ছুঁতোয় উম্মতপনাকে ভেঙে টুকরো করলো। আর আল্লাহ তায়ালা এর শাস্তিস্বরূপ ইংরেজদেরকে চাপিয়ে দিলেন।
স্মরণ রেখো! আমার সম্প্রদায়, আমার অঞ্চল, আমার ভাই, এসব বুলি উম্মাহকে খান খান করে দেয়। আল্লহর কাছে এসব কথা এত অপছন্দনীয় যে, হযরত সাদ বিন উবাদা রা. এর মতো মহান সাহাবীর যে ভুল হয়েছিল, যদি তা না মিটতো, তাহলে আনসার ও মুহাজির সাহাবীদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হতো। দুনিয়াতেই এর ফল তাঁকে ভোগ করতে হতো। বর্ণনায় এসেছে যে, তাঁকে জিনরাই হত্যা করেছিল। আর মদিনায় অদৃশ্য থেকে নিম্নের কবিতার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল।
نحن قتلنا سيد الخزرج سعد بن عبادة و رميناه بسهمين فلم تخط فؤاده.
আমরা খাযরাযের গোত্রপ্রতি সাদ ইবনে উবাদার হৃৎপিণ্ডে দু টা তীর বিঁধিয়ে তাকে হত্যা করেছি।
এ ঘটনাটা এ সবক দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, যদি কোন ভালো ব্যক্তিও ভৌগলিক অথবা জাতীয়তার ভিত্তিতে উম্মতপনাকে ভেঙে দেয়, আল্লাহ তায়ালাও তাকে ভেঙে দেন।
উম্মাহ তখনই গড়বে, যখন উম্মাহর সর্বস্তরের ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর রেখে যাওয়া দ্বীনের কাজে লেগে থাকবে।
স্মরণ রেখো, মোআমালাত-লেনদেন, মোআশারাত- আচার -ব্যবহার এর দুর্দশা আর সর্বনাশ উম্মতপনাকে ভেঙে দেয়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন অন্যের প্রতি অন্যায়-অবিচার করে, তার হক নষ্ট করে, অথবা তাকে কষ্ট দেয়, তার মানহানি করে, তখন পরস্পর ফাটল সৃষ্টি হয়। উম্মতপনা ভেঙে যায়। এই জন্য আমি বলি যে, শুধু কালিমা-তাসবিহ দ্বারা উম্মাহ গড়ে না, মোআমালাত-মোআশারাতের শুদ্ধতা, সকলের হক আদায়, ও সবার সম্মান করা এমনকি সকলের তরে নিজের হক ও লাভের কুরবানি করার মাধ্যমে উম্মাহ বনে। নবীজি (সা.), হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রাযি.) তাঁরা নিজেদের সব কিছু কুরবান করে এবং সমূহ কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে এই উম্মাহ গড়ে তুলেছেন। একদা হযরত ওমরের যুগে লক্ষ-কোটি অর্থের আমদানি হয়। সেগুলোর বণ্টনের মশওয়ারা হলো। সে সময় উম্মাহর ঐক্য ছিল। পরামর্শদাতারা কোন এক গোত্রের কিংবা এক শ্রেণির ছিল না। বরং বিভিন্ন গোত্র ও শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যারা নবীজির সোহবত লাভে প্রথমসারির ও বিশিষ্ট্যজন বিবেচ্য হতেন। তাঁরা পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সবচে বেশি নবীজির গোত্রের লোকদেরকে দেওয়া হবে, এরপর দেওয়া হবে হযরত আবু বকর, অতঃপর হযরত ওমরের গোত্রের লোকদের। এভাবে হযরত ওমরের নিকটাত্মীয়দের পালা তৃতীয় নাম্বারে আসল। হযরত ওমরের নিকট এ বণ্টন পদ্ধতি পেশ করা হলে তিনি এ বলে তা নাকচ করে দিলেন যে, এই উম্মাহ যা কিছু পাচ্ছে তা নবীজির বরকতেরই ফল বৈ কিছু নয়। অতএব নবীজির সম্বন্ধই হবে বণ্টনের ভিত্তি। যারা বংশের দিক থেকে নবীজির যত কাছের হবে তাদেরকে তত বেশি দেওয়া হবে। এভাবে ক্রমানুসারে বণ্টন করা হবে। তাই সবচে বেশি দেওয়া হবে বনি হাশেম কে। এরপর বনি আব্দে মানাফ, বনি কুসাই, বনি কেলাব ও বনি মুররাহকে দেওয়া হবে। এ হিসেবে হযরত ওমরের কবিলা অনেক পিছে পড়ে গেল এবং তাদের অংশও অনেক কমে গেল। তবুও হযরত ওমর এই ফয়সালাই করলেন। আর অর্থ বণ্টনে নিজ কবিলাকে এত পিছে রেখেই গড়েছিলেন উম্মাহর ঐক্য।’
(চলবে ইনশা আল্লাহ)