হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক: কী শরীয়াসমম্মত?
১ ডিসেম্বর থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় প্রথম চালু হয়েছে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক। মায়ের দুধ আহরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণের এ পদ্ধতিটি বাংলাদেশে নতুন যা সচেতন ইসলামি মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা থেকে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উৎপত্তি। পাশ্চাত্যের সামাজিক বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং আশঙ্কাজনক হারে অশস্নীলতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে মিল্ক ব্যাংকের আবিষ্কার। বাহ্যত এর উদ্দেশ্য মহৎ ও মানবিক। যে সব শিশুর মা মারা যায় অথবা কুড়িয়ে পাওয়া স্বজন-পরিত্যক্ত শিশু, তাদের মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন পড়ে। অপর দিকে যেসব শিশু মারা যায় তাদের মায়ের দুধগুলো ফেলে দিতে হয় অথবা ক্ষেত্র বিশেষে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরও অনেক মায়ের স্তনে অতিরিক্ত দুধ জমা থাকে। এসব মায়ের দুধ সংগ্রহ করে মাতৃহারা ও পরিত্যক্ত শিশুদের সরবরাহ করা গেলে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাবে। মাতৃদুগ্ধের মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে যা শিশুর দৈহিক-মানসিক গঠন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিও) হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। বিনামূল্যে এ পরিষেবা প্রদান করা হবে। প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যাংকটি বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় স্থাপন করা হয়েছে।
উদ্যোক্তাদের দাবি হলো হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বাংলাদেশে নতুন হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা চালু রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে এর সুফল অত্যধিক। পুরো ব্রাজিলে ২১৬টি মিল্ক ব্যাংক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ২৮ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু রোধ এবং ৭৩ শতাংশ শিশুর অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। মুসলিম দেশের মধ্যে কুয়েত, ইরান, ইরাক, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে এ ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে।
অন্য মায়ের বুক থেকে মাতৃহারা শিশুদের দু’বছরের মধ্যে দুগ্ধপান শরীয়তে অনুমোদিত। চাই মহিলার স্তন থেকে সরাসরি পান করুক, চাই দুধ বের করে অন্য মাধ্যমে পান করুক (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৬/২৩২)। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) সূরা আন-নিসার ২৩-২৪ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘যেসব নারীর দুধ পান করা হয়, তারা জননী না হলেও জননীর পর্যায়ভূক্ত এবং তাদের সাথে বিয়ে হারাম। অল্প দুধ পান করুক কিংবা বেশি। একবার পান করুক কিংবা একাধিকবার। সর্বাবস্থায় তারা হারাম হয়ে যায়। ফিকহবিদদের পরিভাষায় একে ‘হুরমতে রিযাআত’ বলা হয়। শিশু অবস্থায় দুধ পান করলে এ ‘হুরমতে রিযাআত’ কার্যকর হয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এই সময়কাল হচ্ছে, আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর মতে দু’বছর বয়স পর্যন্ত দুধ পান করা যাবে। দুধ পানের নির্দিষ্ট সময়কালে কোন শিশু কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করলে সে মহিলা শিশুটির মা এবং মহিলার স্বামী শিশুটির পিতা হয়ে যায়। অনুরূপ সে মহিলার আপন পুত্র-কন্যা শিশুটির ভাই-বোন হয়ে যায়। মহিলার বোনেরা তার খালা হয়ে যায়। মহিলার স্বামী ভাই-বোনেরা শিশুটির চাচা ও ফুফু হয়ে যায়। দুধ পানের কারণে তাদের সবার পারস্পরিক বৈবাহিক সম্পর্ক অবৈধ। বংশগত সম্পর্কের কারণে পরস্পর যে সব বিয়ে হারাম হয়, দুধ পানের সম্পর্কের কারণে সেসব সম্পর্কীয়দের সাথে বিয়ে হারাম হয়ে যায়। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে, মহানবী (সা.) বলেন, কোন পুরুষশিশু বা কন্যাশিশু কোন মহিলার দুধ পান করলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না। এমনকি দুধভাই ও বোনের কন্যার সাথেও বিয়ে হতে পারে না (মাআরিফুল কুরআন, মদীনা, পৃ. ২৪১-২৪২)। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) দুধ পানের বয়স আড়াই বছর বললেও ইমাম আবু ইউসূফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর অভিমতে ওপর উম্মতের ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ শিশু দু’বছর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ খেতে পারবে (কিফায়তুল মুফতি, ৫/১৭৫; আহসানুল ফাতওয়া, ৫/১২৮)।
আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের জন্মদাত্রী মা আমিনা মারা গেলে সাআদ গোত্রের হালিমাতুস সাদিয়ার বুক থেকে দুধ পান করেন। সাহাবাদের এবং পরবর্তী যুগেও মুসলিম সমাজে এ রেওয়াজ চালু রয়েছে। দুগ্ধদাত্রী মা ওই মাতৃহারা শিশুর দুধ মা এবং ওই মায়ের ছেলে মেয়েরা অনাথ শিশুরটির দুধ ভাই-বোন। আপন ভাই-বোনের মধ্যে যেমন বিয়ে জায়েয নেই তেমনি দুধ ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে হারাম। ইসলামী আইনের প্রতিটি বিধান যৌক্তিক, বৌদ্ধিক ও বিজ্ঞানসম্মত। আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে জানা যায়, আপন ভাই-বোন ও দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হওয়ার এবং জেনেটিক সমস্যা উদ্ভবের আশঙ্কা থেকে যায় (Beemnet Mengesha Kassahun, PhD Scholar, Kyungpook National University | KNU · Department of Horticulture Science [Genome Engineering]., Korea.)|
হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের প্রক্রিয়াটি জটিল। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কেবল দুধ আহরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করলে নানাবিধ সংকট তৈরি হবে। এতে করে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার এবং পরিবারপ্রথা ভেঙে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হবে। ইসলামে দুধ মায়ের যে বিধান তথা দুধ ভাই-বোনকে বিয়ে করা যে হারাম এই বিধান অনেকটাই লঙ্ঘিত হবে। কারণ, কে কার দুধ খেল তা তো জানা যাবে না। তবে যদি কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের দুধ আলাদা করে রাখেন এবং প্রত্যেক মায়ের বিস্তারিত (তার সন্তানসহ) পরিচয় ও ঠিকানা সংরক্ষণ করেন, তেমনি যে শিশু এখান থেকে দুধ খাবে তার বিস্তারিত তথ্য লিখে রাখেন এবং পরস্পরকে এসব তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে আদান-প্রদান করেন তাহলে জায়েজের একটা সুযোগ থাকবে। তবে এ প্রক্রিয়া অনেক কঠিন এবং এ জন্য বিশেষজ্ঞ আলিম-মুফতিদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।
মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ এমন মায়েদের তালিকা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারেন যাদের অন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর মতো সুযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে কোনো শিশুর দুধ প্রয়োজন হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই মায়ের সঙ্গে সংযোগ করে দিয়ে দুধ পানের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এতে করে দুধ মা কে তা নির্দিষ্ট থাকল। শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ মূলত লিয়াঁজো অফিসের কাজটি করবেন।
মাতুয়াইলে প্রতিষ্ঠিত হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক ডা. মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ধর্মীয় সব বিষয় মাথায় রেখে এবং ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেই এটা করা হয়েছে বিপন্ন শিশুদের কথা চিন্তা করে। মুসলিমদের জন্য কোনটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না এ নিয়ে কয়েক মাস আমরা কাজ করেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আলিমদের সামনে ব্রিফিং করেছি। আমরা নিশ্চিত করেছি যে এটি নিয়ে বিভ্রানিত্মর সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি মায়ের দুধ আলাদা বিশেষ পাত্রে নেওয়া হবে এবং আলাদা লেবেলিং থাকবে যা কখনও নষ্ট হবে না। যিনি দুধ দেবেন তার অনুমতি নেওয়া হবে। তিনি নিজেও নিজের দুধ প্রয়োজনে নিতে পারবেন বা অন্য কেউ নিলে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে আইডি কার্ড থাকবে। দাতা ও গ্রহীতা এ বিষয়ে একে অন্যের বিস্তারিত জানতে পারবে’ (বিবিসি বাংলা; সময়ের আলো, ঢাকা, ২৭.১২.২০১৯)।
ইতোমধ্যে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে আইনি নোটিস প্রেরণ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্কানো), নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে ডাকযোগে পাঠানো নোটিসে বলা হয়, ‘মিল্ক ব্যাংক’ ইস্যুতে ধর্মীয় সমস্যা রয়েছে। তা ছাড়া দেশে মিল্ক ব্যাংক করা ১৯৩৭ সালের মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। তাই নোটিস অনুসারে মিল্ক ব্যাংক স্থাপনে যথাযথ শর্ত আরোপ চাওয়া হয়েছে। অন্যথায় এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নোটিসে উল্লেখ করা হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের বৈধতা আছে কি না জানতে চাইলে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি আরশাদ রাহমানী গণমাধ্যমকে বলেন, যেহেতু এটা দুধ পানের বিষয় এ নিয়ে ইসলামে নির্দিষ্ট মাসয়ালা রয়েছে। মৌলিকভাবে এক মায়ের দুধ অন্য মায়ের শিশু খাওয়া জায়েয। মায়ের দুধ যেকোনো প্রক্রিয়ায় বের করে অন্য শিশুকে খাওয়ানো জায়েয। তবে ইসলামে রক্তের সম্পর্ক এবং দুধ ভাই-বোনের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপন ভাই-বোনের মধ্যে যেমন বিয়ে করা যায় না তেমনি দুধ ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে করা ইসলামে নিষিদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের দুধ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে কোন মায়ের দুধ কোন শিশু খাচ্ছে এটা জানা যাবে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যদি জানা না যায় তাহলে একদিকে যেমন ইসলামে দুধ মায়ের যে গুরুত্ব সেটা ক্ষুন্ন হবে। অন্যদিকে পরবর্তী সময়ে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্য কোন মায়ের দুধ কোন শিশু খাচ্ছে এটা যদি জানা যায় এবং দুই পরিবারের মধ্যে এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন তাহলে সমস্যা নেই। তবে বাস্তবে সবাই কতটা সতর্ক থাকবেন সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া উদ্যোক্তারা কতটুকু শরীয়তের বিধান মানবেন সেটাও ভাববার বিষয়। তাই আমি মনে করি এ ধরনের ব্যাংক না হওয়াই নিরাপদ’ (আওয়ার ইসলাম২৪.কম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)।
রাজধানীর শায়েখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া ব্যাপকতা লাভ করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। অসংখ্য হারাম বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সবার অজানেত্মই, যা সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনার পাশাপাশি ইসলামী পরিবারপ্রথাকেও হুমকির মুখে ফেলবে। তাই এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশ্বের মুহাক্কিক সব আলিমই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠাকে নাজায়েয ঘোষণা করেন (ফাতেহ২৪.কম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯)।
১৯৮৫ সালে ২২-২৮ ডিসেম্বরে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি-এর ফিকহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে, মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা শরীয়তসম্মত নয়; হারাম। ১৯৮৩ সালে ২৪ মে কুয়েতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ড. ইউসুফ আল০কারযাভী মিল্ক ব্যাংক নামে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বিশেষ অবস্থায় তার বৈধ হওয়ার পক্ষে মত দেন; তবে সেমিনারে উপস্থিত বিজ্ঞ ফকীহদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। ১৯৬৩ সালে ৮ জুলাই মিসরের দারুল ইফতার প্রদত্ত এক ফাতওয়ায় বলা হয় নির্দিষ্ট কতিপয় মূলনীতি মেনে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে শারয়ী কোনো বাধা নেই। ১৯৯৩ সালে সরকারি এক ফাতওয়ায় বলা হয় মাতৃদুগ্ধকে পাউডার বানিয়ে পরবর্তীতে পানি মিশিয়ে শিশুকে খাওয়ালে হারাম সাব্যস্থ হবে না।
স্বাস্থ্যগত ও ধর্মীয় উভয় দিক বিবেচনায় মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক ফিকহ বোর্ডে। বিশেষজ্ঞগণ গবেষণার নানা আঙ্গিক নিয়ে পর্যালোচনা করেন। সর্বশেষ ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (বর্তমানে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) জেদ্দায় ২২ থেকে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে তার দ্বিতীয় সম্মেলনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচিত হয়:
- মিল্ক ব্যাংকের ধারণা তৈরি হয়েছে পাশ্চাত্য জাতিগুলো থেকে। তারাই এটা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক কিছু নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে তার পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং তার গুরুত্ব কমে যায়।
- ইসলামের দৃষ্টিতে দুগ্ধপান দ্বারা রক্তের সম্পর্ক (বা আত্মীয়তা) তৈরি হয়। সুতরাং সব মুসলমানের ঐকমত্যে, রক্ত সম্পর্কের দ্বারা যা হারাম হবে (অর্থাৎ যাদের বিবাহ করা হারাম, দেখা দেওয়া জায়েয) দুধপানের দ্বারাও তারা হারাম হবে। শরিয়তের বড় একটি উদ্দেশ্য হলো বংশ সম্পর্ক রক্ষা করা। আর এ মিল্ক ব্যাংক বংশ সম্পর্ক নষ্ট করবে বা সন্দেহপূর্ণ করে তুলবে।
- ইসলামি বিশ্বের সামাজিক ব্যবস্থাপনা বিশেষ ক্ষেত্রে স্বভাবজাত মাতৃদুগ্ধপানের ব্যবস্থা করে থাকে যখন বাচ্চা অপূর্ণাঙ্গ বা স্বল্পওজনি হয় কিংবা মাতৃদুগ্ধের মুখাপেক্ষী হয়। এ ব্যবস্থাপনা থাকলে মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজন পড়বে না।
উদ্ভুত পরিস্থিতির বিবেচনায় ইসলামী আইন বিশেজ্ঞগণ দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রথমত ইসলামি বিশ্বে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে হুরমতে রেযাআত তথা বংশীয় সম্পর্কের মতো পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হবে (অনুবাদ: যাইনুল আবেদীন ইবরাহীম, আলোকিত বাংলাদেশ, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯)।
ঢাকা মারকাযুদ দাওয়া আল-ইসলামিয়ার সিনিয়র মুফতি মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ মিল্কব্যাংক বিষয়ে বলেন, পাশ্চাত্যের অনুসরণে মিল্কব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করা একটি মুসলিম সামাজিকতা বিরোধী উদ্যোগ। বাঙালি মুসলিমের আবহমান সংস্কৃতি পরিপন্থী একটি কাজ। ধর্মীয় বিধি নিষেধ তো আছেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিন্দনীয়।
মিল্কব্যাংক বিষয়ে রাজধানীর বায়তুল উলূম ঢালকানগরের মুহাদ্দিস মুফতি শাব্বীর আহমাদ বলেন, মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণ ও বিতরণের এ উদ্যোগটিকে আপাত দৃষ্টিতে কেউ কল্যাণকর মনে করতে পারেন। কিন্তু ইসলামে পারিবারিক সম্পর্কের যে স্থিতিশীলতা এর মাধ্যমে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা বিদ্যমান। প্রয়োজন হলে কোনো মুসলিম শিশুকে নির্দিষ্ট অন্য কোনো মুসলিম নারীর দুধ পান করানো অবশ্যই জায়েয। এটা কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিতও। তবে দুধ সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য মিল্কব্যাংক এর অনুমতি শরীয়ত দেয় না। মিল্কব্যাংক কর্তৃক ডোনারদের ডাটা সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একটি ঘোষণা মাত্র। এর বাস্তবায়ন কতটুকু কী হবে তা সংশয়পূর্ণ। তাছাড়া এমন অনেক পদ্ধতি আছে যেখানে ডাটা সংরক্ষণেরও তেমন কার্যকরিতা থাকবে না। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় মিল্কব্যাংককে হালাল বলার কোনো সুযোগ নেই (ইসলাম টাইমস, ঢাকা, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯)।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ও শরীয়াহ আইন বিশেষজ্ঞ মাওলানা ড. আহমদ আলী বলেন, পর্যালোচনায় বোঝা যায়, মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শুরু থেকেই ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য চলে আসছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাবে কিনা? এতে শরয়ী ও নৈতিকভাবে কী কী সমস্যা রয়েছে? যদি প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে এর বিকল্প কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে? যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে কোন কোন অবস্থায় এবং কী কী শর্তে করা যেতে পারে? আমি মনে করি, এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার আগে আরো অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক যেহেতু বাংলাদেশে নতুন এবং আয়োজকরা কতটুকু শারীয়তসম্মত পন্থায় করতে পারবেন এসব বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া দরকার। দেশের শীর্ষ আলিম, স্কলার ও মুফতিদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও গোলটেবিল কনফারেন্স হতে পারে। মিল্ক ব্যাংক বিষয়ে সংশিস্নষ্ট উদ্যোক্তাদের সঙ্গে খোলামেলা, আন্তরিক ও প্রামাণ্য আলোচনা চলতে পারে। এতে করে নতুন বিকল্পপথ উন্মোচিত হবে। সরকারি কোন সংস্থা বিশেষ করে ধর্ম মন্ত্রণালয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে করে শিশুর প্রাণও রক্ষা পাবে এবং শরীয়তের বিধিও লঙ্ঘিত হবে না।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন