রোহিঙ্গাদের আস্থায় নিয়ে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা মিয়ানমারের দায়িত্ব
পূর্ণপ্রস্তুতি থাকা সত্ত্ব্বেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি না হওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেছে। ২২ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে যেতে রাজি হননি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কেরনতলী ট্রানজিট ক্যাম্প ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমমধুম ট্রানজিট ক্যাম্পসহ সব ধরণের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। মিয়ানমার সরকারের দেওয়া ছাড়পত্র অনুযায়ী এক হাজার ৩৭টি পরিবারের মোট তিন হাজার ৫৪০ জনকে ফেরত নেওয়ার তালিকাটি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি না হলে কোন শরণার্থীকে জোর জবরদস্তি করে পাঠানোর বিধান নেই।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। সেবছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, গতবছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও নির্যাতনের মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজদেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।
রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে কেন আগ্রহী নয় এর কারণসমূহ খতিয়ে দেখতে হবে। (ক) রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের আশ্বাসের ওপর আস্থা ও ভরসা রাখতে পারছেন না। (খ) আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার ভাষ্য মতে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রচুর ক্যাম্প ও ডরমেটরি তৈরি করা হয়েছে। উইঘুর মুসলমানদেরকে যে ভাবে চীনের ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়েছে তেমনি রোহিঙ্গাদেরকেও রাখা হতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা কাজ করছে। বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে রাখাইনের ক্যাম্পে যেতে তাঁরা আগ্রহী নন। (গ) বাংলাদেশে বিনাশ্রমে ফ্রি থাকা, খাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় অনেকে আরাকানে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। এখান থেকে অন্যান্য দেশে চলে যাওয়ার একটা পথ তৈরি হতে পারে, এমন একটা প্রত্যাশা অনেকের আছে। (ঘ) চীন বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা সমীচীন নয়। এই বিষয়টি রোহিঙ্গাদের ভাবিয়ে তুলেছে। নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। বাস্তুভিটা, শিক্ষা, চারণভূমি, ফসলি জমি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার ফিরে পাওয়া নাগরিকত্বের ওপর নির্ভরশীল।
(ঘ) কোন কোন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) রোহিঙ্গাদের ফিরে না যাওয়ার জন্য ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রচারণা চালাচ্ছে। এর কারণ ও যৌক্তিকতা খুঁজতে হবে। এর নেপথ্যে কী খ্রিস্টধর্মপ্রচার না শরণার্থী বাণিজ্য অথবা মানবপাচার তদন্ত করে বের করতে হবে।
টেকনাফ উপজেলার শালবাগান ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান বজলুর ইসলাম রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সাংবাদিকদের যে কথা বলেন তাতে রোহিঙ্গাদের ফিরে না যাওয়ার ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকত্বসহ দাবিকৃত ৫টি শর্ত না মানলে কিছুতেই মিয়ানমার ফিরে যাবো না। আগে রাখাইনে বন্দি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাই। কারণ, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইনে ফিরতে চাই, তবে ফিরে যাওয়ার মত পরিস্থিতি এখনও রাখাইনে সৃষ্টি হয়নি। মিয়ানমার সরকার এখনও মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করছে। এ অবস্থায় রাখাইনে যাওয়া মানে পুনরায় বিপদ ডেকে আনা। তাই আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় মিয়ানমার সরকারকে চাপে ফেলে আমাদের অধিকার ও শর্তগুলো আদায় করা হোক। তাহলে আমরা মিয়ানমার ফিরবো।’
২২ আগস্ট বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের যে কথা বলেছেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা সর্বশেষ চতুর্থ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে প্রস্তাব করেছিলাম, আস্থা তৈরির জন্য কক্সবাজারের একাধিক শিবিরে যেসব রোহিঙ্গা মাঝি বা নেতারা রয়েছেন তাদের রাখাইন নিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হোক, যেন রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার যে অভাব আছে তা দূর হয়।’
প্রত্যাবাসনের পূর্বে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
(ক) রোহিঙ্গাদের নিজ ভিটায় পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। (খ) নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (গ) জান মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। (ঘ) ভিটা-বাড়ি, গবাদি পশু, দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ফসলাদি যেগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। (ঙ) কসভোর মত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আরাকানকে নিরাপদ অঞ্চল (Safe zone) ঘোষণা করা। (চ) হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্ত এবং দোষীদের মানবতাবিরোধী অপরাধে শাস্তির বিধান করা।
মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে আরাকানের বিভিন্ন স্থানে ৫টি গণকবর আবিস্কৃত হয়েছে। প্রতিটি কবরে রয়েছে ২৫০টি লাশ। এ পর্যন্ত সাংবাদিক ও জাতিসংঘসহ কোন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আরাকানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। প্রবেশাধিকার দিলে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে জাতিনিধনযজ্ঞের নৃশংস ও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন